শনিবার   ৩০ নভেম্বর ২০২৪ |  অগ্রাহায়ণ ১৫ ১৪৩১ |   ২৮ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

প্রেমিকাকে যৌনপল্লীতে বিক্রির বদলা নিতে তিন নারীকে বিভৎসভাবে খুন

প্রকাশিত: ২২ আগস্ট ২০২২ ১৬ ০৪ ০১  

প্রেমিকাকে-যৌনপল্লীতে-বিক্রির-বদলা-নিতে-তিন-নারীকে-বিভৎসভাবে-খুন

প্রেমিকাকে-যৌনপল্লীতে-বিক্রির-বদলা-নিতে-তিন-নারীকে-বিভৎসভাবে-খুন

তিন নারীকে খুনের অভিযোগে সিদ্ধলিঙ্গাপ্পার নামের যুবককে কর্নাটকের মান্ডিয়া থানায় জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। ভয়ংকর এ কিলার পুলিশের কাছে তিনটি খুনের কথা স্বীকার করেছে। সাতটি খুনের প্রতিজ্ঞা করলেও তিন নারীকে খুনের পরই তাকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ।

পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদের শেষের দিকে সিদ্ধলিঙ্গাপ্পা জানায়, সাতজনকে নয়, আটজনকে খুনের মহাপরিকল্পনা করেছিল সে। প্রেমিকাকে যৌনপল্লীতে বিক্রি করার কারণেই এসব খুন করেছে সিদ্ধলিঙ্গাপ্পা। কিন্তু সাতজনের পরই প্রেমিকাকে খুনের ছক কষে রাখে সে। প্রেমিকাকে খুনের কথা শুনে হতভম্ব হয়ে যায় পুলিশ। তবে কেন প্রেমিকাকে মেরে ফেলতে চেয়েছিল সিদ্ধলিঙ্গাপ্পা?

ঘটনার সূত্রপাত, চলতি বছরের ৮ জুন। মহীশূরের কাছে একটি ছোট্ট গ্রাম মান্ডিয়া। সেই দিনই এ গ্রামের নদীর ধার থেকে উদ্ধার হয় এক নারীর মরদেহ। নদীর পাশ দিয়ে যাবার সময় এক ব্যক্তি মরদেহটি দেখতে পান। মরদেহের অবস্থা দেখে আঁতকে উঠে চিৎকার করে ওঠেন তিনি। কারণ, মরদেহটির শরীরের কোমর পর্যন্ত কাটা ছিল। কোমর থেকে নিচের অংশ দেখতে পাওয়া গেলেও উধাও ছিল মরদেহটির মুখসহ শরীরের উপরের অংশ।

কাটা মরদেহ দেখে পালিয়ে যান ঐ ব্যক্তি। পুরো বিষয়টি শুনে পুলিশ এসে উপস্থিত হয় ঘটনাস্থলে। পুলিশ এসে কাটা মরদেহটি উদ্ধার করে। মরদেহের বাকি অংশ উদ্ধার করতে ঐ এলাকা তন্ন তন্ন করে খুঁজেও কিছু পাওয়া যায়নি।

এ ঘটনার কয়েক ঘণ্টা পর ২৫ কিলোমিটার দূরে খোঁজ পাওয়া যায় আরো এক নারীর মরদেহ। কাকতালীয়ভাবে এ মরদেহেরও অর্ধেক অংশ গায়েব ছিল। খবর ছড়িয়ে পড়তেই প্রথম মরদেহের অর্ধেক অংশ খুঁজে পাওয়া গিয়েছে ভেবে পুলিশ সেখানে পৌঁছায়। কিন্তু ঘটনাস্থলে পৌঁছে পুলিশ হতভম্ব হয়ে যায়। কারণ এ মরদেহেরও শরীরের কোমর থেকে উপরের অংশ গায়েব ছিল। পড়ে ছিল কোমর থেকে নিচের অংশ।

নারীর মরদেহ উদ্ধার করা হয়- ছবি: সংগৃহীত

কর্নাটকের এ ছোট্ট গ্রামের ২৫ কিলোমিটারের মধ্যে দুই নারীর মরদেহ উদ্ধার হয়। দুটি মরদেহেরই কোমর থেকে উপরের অংশ গায়েব ছিল। ফলে মরদেহ দু’টি কার, এ নিয়ে দ্বন্দ্বে পড়ে পুলিশ। পরিচয় না পাওয়া গেলেও প্রাথমিক তদন্তের পর এবং মরদেহ দু’টি অর্ধেক করার ধরন দেখে পুলিশের ধারণা হয়, এ দুই হত্যাকাণ্ডের পিছনে এক জনেরই হাত আছে।

পুলিশ সবার প্রথম মরদেহের পরিচয় জানতে কর্নাটক এবং আশপাশের রাজ্যগুলোতে নিখোঁজ নারীদের খোঁজে নামে। পাশাপাশি মহীশূর এবং কাছের এলাকাগুলোতে প্রায় ১০ হাজার প্রচার পুস্তিকাও বিতরণ করে। এরই মধ্যেই ময়নাতদন্তের পর চিকিৎসকরা জানান, মৃত দুই নারীর বয়স ২৫ থেকে ৩৫-এর মধ্যে ছিল।

মরদেহ শনাক্ত করার কাজে নামে পুলিশের নয়টি আলাদা দল। প্রতিটি দলে পাঁচজন করে মোট ৪৫ জন পুলিশকর্মী এ ঘটনার তদন্তে নামেন। তদন্তে নামার পর পুলিশ জানতে পারে ২৫ থেকে ৩৫-এর মধ্যে বয়স, এমন ১ হাজার ১১৬ জন কর্নাটক থেকে নিখোঁজ হয়েছেন।

মৃত্যুর দিনক্ষণ মিলিয়ে সেই তালিকা থেকে অনেক নিখোঁজ নারীকেই বাদ দেওয়া হয়। বয়স না মেলার কারণেও তালিকা থেকে বাদ যান বহু নারী।

এরই মধ্যেই ঘটনার দুই মাস পেরিয়ে যায়। দুই নারী খোঁজে পুলিশের তদন্তকারী একটি দল বেঙ্গালুরুর কাছে একটি বাড়িতে পৌঁছায়। এ বাড়ি থেকে এক জন নারী জুন মাসের গোড়ার দিকে নিখোঁজ হয়ে যান। মিলে যায় তার বয়সও। এরপর মরদেহ দুটির শরীরে থাকা কাপড়ের ছবি ঐ বাড়ির লোকদের দেখানোয় তা চিহ্নিত করেন তারা।

পুলিশ আরও নিশ্চিত হতে ঐ পরিবারের নিখোঁজ নারীর ফোন নম্বর নিয়ে ফোনের শেষ লোকেশন ট্র্যাক করার কাজে নামে। পুলিশ দেখে ঐ নারীর ফোন খুনের ঘটনার কাছে মরদেহ উদ্ধারের এক দিন আগেও সক্রিয় ছিল। ঐ নারী ফোনে কার কার সঙ্গে কথা বলেছেন তা বের করে তিন জনকে সন্দেহের তালিকায় ফেলে পুলিশ।

সন্দেহের তালিকায় থাকা তিনজনের মধ্যে একজন ছিল সিদ্ধলিঙ্গাপ্পা। পুলিশ দেখে সিদ্ধলিঙ্গাপ্পার ফোনের লোকেশনও মরদেহ উদ্ধারের একদিন আগে ঐ জায়গাতেই ছিল। সিদ্ধলিঙ্গাপ্পার মোবাইল নম্বর থেকে তার ঠিকানা খুঁজে পেতে পুলিশকে বিশেষ কষ্ট করতে হয়নি। সিদ্ধলিঙ্গাপ্পাকে তার বাড়ি থেকে গ্রেফতার করে পুলিশ।

জেরার মুখে প্রথমে খুনের কথা অস্বীকার করলেও পরে সিদ্ধলিঙ্গাপ্পা জানায় এ খুন সে-ই করেছে। এমনকি ২৫ কিলোমিটার দূরে অন্য যে নারীর অর্ধেক মরদেহ উদ্ধার হয়েছে, তাকেও সে খুন করেছে বলে জানায়। এছাড়া বেঙ্গালুরুতে আরো একজন নারীকে খুন করার কথা স্বীকার করে সে।

পুলিশ খুনের কারণ জানতে চাইলে সে যা জানায়, তা যেকোনো সিনেমার গল্পকে হার মানাবে।

সিদ্ধলিঙ্গাপ্পা বেঙ্গালুরুর একটি কাপড়ের কারখানায় কাজ করতো। বেঙ্গালুরুতে থাকাকালীন সেখানকার এক যৌনপল্লীতে নিয়মিত যাতায়াত ছিল তার। সেখানেই চিত্রকলা নামে এক যৌনকর্মীর সঙ্গে তার দেখা হয়। কিছু দিন নিয়মিতভাবে চিত্রকলার সঙ্গে মেলামেশা করার পর তার প্রেমে পড়ে সিদ্ধলিঙ্গাপ্পা। প্রেমে সাড়া দেন চিত্রকলাও।

চিত্রকলার আচার-ব্যবহার, চলন-বলন দেখে তাকে এ পরিবেশে মানিয়ে নিতে পারছিলেন না সিদ্ধলিঙ্গাপ্পা। কীভাবে চিত্রকলা এখানে এলেন, তা জানার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠেন সিদ্ধলিঙ্গাপ্পা।

চিত্রকলা তাকে জানান, বছর দু’য়েক আগে তার পরিবারের আর্থিক অবস্থার অবনতি হয়। এরপরই চাকরি করার সিদ্ধান্ত নেন তিনি। চাকরির খোঁজে বিভিন্ন মানুষের দ্বারস্থ হয়েও বিশেষ লাভ হয়নি। এরপরেই পরিচিত কিছু নারীর সঙ্গে যোগাযোগ করলে তারা চাকরি দেওয়ার নাম করে চিত্রকলাকে যৌনপল্লীতে এনে বিক্রি করে দেন। চিত্রকলা জানান, তাদের এ কাজে সাহায্য করেন চার জন পুরুষও।

চিত্রকলার জীবন বৃত্তান্ত শুনে সিদ্ধলিঙ্গাপ্পা আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন। চিত্রকলার এ পরিণতির জন্য যারা দায়ী, তাদের পৃথিবী থেকে সরিয়ে নেয়ার পরিকল্পনা করেন এ যুগল। ঠিক করেন প্রথমে তিন নারীকে শেষ করবেন এবং পরে খুন করবেন ঐ চার পুরুষকে।

চিত্রকলাকে এ পেশায় নামানোর জন্য দায়ী নারীরা নিজেরাও যৌনপেশার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এদের মধ্যে এক নারীর বাড়ি ছিল বেঙ্গালুরুর কাছে। চিত্রকলার থেকে ঐ নারীর নম্বর নিয়ে তাকে ফোন করে ডেকে পাঠায় সিদ্ধলিঙ্গাপ্পা। ঐ নারীকে খুন করে তার দেহ টুকরো টুকরো করে আলাদা আলাদা জায়গায় ছড়িয়ে দেয়।

প্রথম খুনের পর বাকিদের খুন করার উদ্দেশ্যে চিত্রকলা এবং সিদ্ধলিঙ্গাপ্পা মান্ডিয়াতে একটি বাড়ি ভাড়া করে থাকতে শুরু করে। বাকি দুই নারীকে একইভাবে ফোন করে ডেকে পর পর দু’দিন দু’জনকে খুন করে সিদ্ধলিঙ্গাপ্পা। এবার আর টুকরো টুকরো করে নয়, খুনের পর এই দুই নারীর মরদেহ দু’টুকরো করে তা ২৫ কিলোমিটারের মধ্যে আলাদা আলাদা জায়গায় রেখে আসে। সেই দুই মরদেহেরই কোমর থেকে নিচের অংশ উদ্ধার করেছিল পুলিশ।

পুলিশ তদন্ত করতে নেমেছে শুনে বাকিদের খুন করার পরিকল্পনা কিছু দিনের জন্য স্থগিত রাখে যুগল। খুনের প্রায় দু’মাস হতে যাওয়ায় সিদ্ধলিঙ্গাপ্পা মনে করে তাকে পুলিশ আর ধরতে পারবে না। কিন্তু জুলাইয়ের শেষে এসে পুলিশের জালে ধরা পড়ে সিদ্ধলিঙ্গাপ্পা।

কিছু দিন ধরে পুলিশকে ধীরে ধীরে পুরো ঘটনা শোনানোর পর জিজ্ঞাসাবাদের শেষ দিনে সে পুলিশ কর্মকর্তাদের জানায়, আসলে আটজনকে খুন করার ইচ্ছা ছিল তার। সিদ্ধলিঙ্গাপ্পার ‘হিটলিস্ট’-এর শেষ নাম নাকি ছিল খোদ চিত্রকলার। এ কথা শুনে পুলিশ তাকে এ রকম চিন্তার কারণ জানতে চাইলে তার উত্তর শুনে থ হয়ে যান পুলিশ কর্মকর্তারা। যাকে ভালবেসে এতগুলো খুন করার এ সিদ্ধান্ত অবশেষে সেই চিত্রকলাকেই নাকি খুন করতে চেয়েছিলেন সিদ্ধলিঙ্গাপ্পা!

সিদ্ধলিঙ্গাপ্পা আরো জানায়, প্রথম ও দ্বিতীয় খুন করার পর ভয় লাগলেও তৃতীয় খুনের পর সে নিজেকে ‘অপরাজেয় সিরিয়াল কিলার’ বলে মনে করতে শুরু করে।

সিদ্ধলিঙ্গাপ্পা পুলিশকে জানায়, সে জানত পুলিশ যদি কোনো দিন তার খোঁজ পায় তাহলে তা পেতে পারে চিত্রকলার কাছ থেকেই। তখন আর তার ‘সর্বোৎকৃষ্ট’ সিরিয়াল কিলার হওয়া হবে না। তাই ঠিক করে নেয় ‘নিখুঁত’ সিরিয়াল কিলার হতে হলে ভালবাসাকে জীবন থেকে সরাতে হবে।

সিদ্ধলিঙ্গাপ্পা জানায়, যেদিন সে পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয়, তার পরদিনই চিত্রকলাকে খুন করার ছক কষেছিল সে। কিন্তু অল্পের জন্য প্রাণে বাঁচে সিদ্ধলিঙ্গাপ্পার প্রেমিকা চিত্রকলা।

প্রাণে বাঁচলেও সিদ্ধলিঙ্গাপ্পার সঙ্গে জেলেই ঠাঁই হয়েছে চিত্রকলার। সিদ্ধলিঙ্গাপার সঙ্গে মিলে এতগুলো খুনের ছক কষার অভিযোগে তাকে গ্রেফতার করে মান্ডিয়া থানার পুলিশ।

-আনন্দবাজার পত্রিকা

Provaati
    দৈনিক প্রভাতী
    এই বিভাগের আরো খবর