বৃহস্পতিবার   ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪ |  আশ্বিন ৪ ১৪৩১ |   ১৫ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

জ্বলছে ভূ-স্বর্গ!

প্রকাশিত: ২২ আগস্ট ২০১৯ ১৪ ০২ ০১  

জ্বলছে-ভূ-স্বর্গ

জ্বলছে-ভূ-স্বর্গ

এই তো সেই কাশ্মীর। যার সম্বন্ধে মুসলিম সম্রাট জাহাঙ্গীর বলেছিলেন- ‘গার ফিরদাউস বার-রুয়ে যামিন আস্ত, হামিন আস্ত, হামিন আস্ত, হামিন আস্ত’। যার অর্থ- ‘পৃথিবীর কোথাও স্বর্গ থাকলে তা এখানেই আছে, এখানেই আছে এবং এখানেই আছে।’ 

এমন উক্তির পর ভাবনার আকাশে যে চিত্রকল্প ফুটে ওঠে তা খুবই মনোমুগ্ধকর। স্বর্গতুল্য। হয়তো এজন্যই পৃথিবীর নানা দেশের মানুষের ভ্রমণের প্রিয় জায়গা ছিল এই কাশ্মীর। নাম শুনলেই সবুজ প্রকৃতির দিকে মন চলে যায়। হৃদয়ে হিল্লোল তুলে মুগ্ধ করা আবেশের। প্রাণে প্রাণে বাজে প্রেরণার সুর। আহ্, কী সুন্দর করে সাজিয়েছেন এ ধরা!যেন প্রভুর হাতে গড়া সুন্দর, মনোরম আর নয়নজুড়ানো ভুবন ভুলানো দৃশ্য। কাশ্মীরের প্রকৃতি নিয়ে কত কবি কবিতা লিখেছেন। কত গল্পকার লিখেছেন হাজার হাজার পৃষ্ঠার রচনা। সাজিয়ে তুলেছেন মনের মাধুরী মিশিয়ে। কাশ্মীরে যাওয়ার তীব্র আকাঙ্ক্ষা হৃদয়ে যে কারোরই বারবার উঁকি দিত। উদ্বেলিত হতো প্রাণ। কিন্তু সেই কাশ্মীরই এখন মৃত্যু উপত্যকা। উত্তপ্ত আগ্নেয়গিরি। যার প্রখর তাপে জ্বলছে দক্ষিণ এশিয়ার দুই শক্তিধর রাষ্ট্র পাকিস্তান ও ভারত। পুরো কাশ্মীর তিন দেশে বিভক্ত। জাম্মু-কাশ্মীর (নর্থ ইন্ডিয়া), আজাদ কাশ্মীর (পাকিস্তান) ও আক্সাই চিন (পাকিস্তান চিনকে উপহার দিয়েছিল)। মূলত ভারতে অংশ নিয়েই বার বার সংকট সৃষ্টি হয়েছে।

সম্প্রতি ভারতের সংবিধানের ৩৭০ ধারা বাতিলের পর এ সংকট আরো প্রকট আকার ধারণ করেছে।  গত ৫ আগস্ট ভারতের প্রেসিডেন্ট রামনাথ কোবিন্দ এক প্রেসিডেন্সিয়াল অর্ডারের মাধ্যমে মুসলিম-অধ্যুষিত রাজ্যটির বিশেষ সুবিধা দেয়া সাংবিধানিক আইনটি বাতিল করেন। এ ছাড়াও জম্মু কাশ্মীর রাজ্যকে ভেঙে দুই টুকরো করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে জম্বু-কাশ্মীর থেকে লাদাখকে আলাদা করা হয়েছে। নতুন দুটি অঞ্চলেই দু’জন লেফটেন্যান্ট গভর্নরের মাধ্যেমে কেন্দ্রীয় শাসনের অধীনে থাকবে। তবে জম্বু কাশ্মীরের জন্য আলাদা বিধানসভা রাখার কথা বলা হলেও লাদাখের বিধানসভা থাকবে না বলে জানানো হয়েছে। থেকেই রাজ্যের ফারুক-ওমর আবদুল্লা, মেহবুবা মুখতি, সাজ্জাদ লোনসহ অন্যান্য গুরত্বপূর্ণ নেতাকে গৃহবন্দী করা হয়। বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়েছে ইন্টারনেট যোগাযোগ ব্যবস্থা, জারি করা হয়েছে ১৪৪ ধারা ও কারফিউ। গোটা কাশ্মীর উপত্যকা এই মুহূর্তে থমথমে। এরইমধ্যে কাশ্মীরের বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতারা স্থানীয় জনগণকে আগামী শুক্রবার জুমার নামাজের পর নিষেধাজ্ঞা ভেঙে বাইরে বেরিয়ে এসে পদযাত্রায় যোগ দেয়ার ডাক দিয়েছেন। বুধবার বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যেমে প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, মঙ্গলবার রাতভর জম্মু ও কাশ্মীরের প্রধান নগরী শ্রীনগরে জনগণকে এ আন্দোলনে নামার ডাক দিয়ে ছাপা পোস্টার ছড়ানো হয়। গত ৫ অগাস্ট ভারত সরকার জম্মু ও কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা তুলে নেওয়ার পর কাশ্মীরে এই প্রথম এভাবে প্রতিবাদের ডাক দেয়া হলো। কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা রোধের পরপরই সেখানকার প্রায় তিন শতাধিক রাজনৈতিক নেতা ও কর্মীকে গ্রেফতার করে পুলিশ। তাদের অনেকেই ভারত সরকার বিরোধী এবং কাশ্মীরের স্বাধীনতার পক্ষে আন্দোলন করেছেন। 

শ্রীনগরে ছড়ানো পোস্টারের মধ্যে একটিতে লেখা ছিল, ‘সব মানুষ, তরুণ ও বৃদ্ধ, পুরুষ ও নারী সবার উচিত জুমার নামাজের পর মিছিলে যোগ দেয়া।’  দ্য ‘জয়েন্ট রেজিসটেন্স লিডারশিপ’ এর নামে এ পোস্টার ছাপা হয়েছে। যেটি কাশ্মীরের বৃহৎ সব বিচ্ছিন্নতাবাদী দলের প্রতিনিধিত্ব করছে। পোস্টারে লোকজনকে শ্রীনগরে অবস্থিত জাতিসংঘের মিলিটারি অবজারভার গ্রুপের কার্যালয়ের দিকে পদযাত্রা করার আহ্বান জানানো হয়েছে। ১৯৪৯ সালে ভারত-পাকিস্তান প্রথম যুদ্ধের পর শ্রীনগরে জাতিসংঘের এ প্রতিষ্ঠানটি স্থাপন করা হয়। বিষয়টি নিয়ে চরমে উঠেছে ভারত-পাকিস্তান দ্বন্দ্ব। বিষয়টি আন্তর্জাতিক আদালতে তোলার কথাও এরইমধ্যে জানিয়েছে পাকিস্তান। এখানেই থেমে নেই। সীমান্তে গোলাগুলিও হচ্ছে। বুধবার কাশ্মীর সীমান্তে ভারত-পাকিস্তানি গোলাগুলিতে ভারতীয় সেনাবাহিনীর এক কর্মকর্তা ও ৫ সৈন্য এবং পাকিস্তানের ৩জন বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছে। অথচ কাশ্মীরের ইতিহাস ছিল অন্যরকম। একটু আলাদা। ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়- মহাভারতে বলা হয়েছে কাশ্মীর ছিল কম্বোজদের রাজ্য। পরবর্তীকালে পাঞ্চালরাও এই ভূখণ্ড শাসন করেছিল। তাওয়াই নদীর ধারে জম্মু নগরীর গোড়াপত্তন খ্রিস্টীয় নবম শতকে, রাজা জম্বুলোচনের হাতে। তার নাম থেকেই নগরীর নামকরণ। ভৌগোলিক পরিচয় বলছে বহু কোটি বছর আগে বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে ছিল শুধুই হ্রদ। তারপর একদিন সেই হ্রদ রূপান্তরিত হল উপত্যকায়। নাম হল ‘কাশ্মীর’। দ্বাদশ শতকে লেখা কবি কলহনের ‘রাজতরঙ্গিনী’-ও বলছে হ্রদ থেকেই কাশ্মীরের উৎপত্তি। সংস্কৃত ভাষায় ‘কা’ শব্দের অর্থ জল।‘শিমিরি’ শব্দের অর্থ ‘শুষ্ক’ করা। অর্থাৎ জল শুকিয়ে যে স্থলভাগের উৎপত্তি, তা-ই ‘কাশ্মীর’। হিন্দু পুরাণ অনুযায়ী, ঋষি কাশ্যপ জলসেচন করে শুষ্ক করেছিলেন। তার নাম থেকেই নামকরণ কাশ্মীরের।

প্রাচীন ভূখণ্ড কাশ্মীরে প্রস্তর যুগেও মানুষের বাস ছিল। বৈদিক যুগে উত্তর-কুরুদের রাজ্য ছিল কাশ্মীর। এরপর সম্রাট অশোকের যুগে মৌর্য সাম্রাজ্যের অংশ ছিল কাশ্মীর। কুষাণ সাম্রাজ্যে কণিষ্কের সময় কাশ্মীর ছিল গুরুত্বপূর্ণ শহর। এই সময় থেকে কাশ্মীর বৌদ্ধধর্ম চর্চার মূল কেন্দ্র হয়ে ওঠে।

এরপর হুন আক্রমণের সময়েও কাশ্মীর ছিল তাদের মূল ঘাঁটি। এরপর কর্কোট এবং উৎপল বংশ ছিল কাশ্মীরের দুই উল্লেখযোগ্য শাসক। ততদিনে ম্লান হতে শুরু করেছে কাশ্মীরের অতীত গৌরব। মধ্যযুগে লোহারা বংশের শাসনে কাশ্মীরের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ধসে পড়ে।

এরপর কাশ্মীর দখল করে তুর্কিরা। তাদের থেকে ক্ষমতা হাতবদল হয় মুঘলদের কাছে। পারস্য ও মধ্য এশিয়ার শিল্প সংস্কৃতিই হয়ে ওঠে কাশ্মীরের নতুন পরিচিতি। একদিকে যেমন প্রাচীন পরিচিতি আড়ালে চলে যায়, অন্যদিকে কাশ্মীরে বিকশিত হয় শাল বয়ন, সূচিশিল্প ও কাঠের কাজ।

মুঘল সাম্রাজ্যের সঙ্গে কাশ্মীর সরাসরি যুক্ত হয়েছিল সম্রাট আকবরের রাজত্বে। উপত্যকায় মুঘল শাসন শেষ হয় অওরঙ্গজেবের শাসনকালেই। নাদির শাহের আক্রমণে আরও দুর্বল হয়ে পড়ে কাশ্মীর।

শিখ সেনাদলে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল ডোগরা রাজপুতদের। প্রথম ইঙ্গ-আফগান যু্দ্ধে ব্রিটিশদের হাতে পরাজিত হয় শিখ শক্তি। ব্রিটিশদের সঙ্গে ডোগরা রাজপুতদের ঘনিষ্ঠতা বাড়ে।

১৮৪৬ খ্রিস্টাব্দে অমৃতসর চুক্তির পরে গুলাব সিংহকে প্রিন্সলি স্টেট জম্মু কাশ্মীরের প্রথম মহারাজা ঘোষণা করে ব্রিটিশরা। বিনিময়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কোষাগারে গুলাব সিংহকে দিতে হয় বিপুল অঙ্কের অর্থ। ব্রিটিশ ভারতের দ্বিতীয় বৃহত্তম দেশীয় রাজন্য স্টেটের প্রথম রাজা ছিলেন মহারাজা গুলাব সিংহ জামওয়াল।

১৯২৫ খ্রিস্টাব্দে জম্মু কাশ্মীর প্রিন্সলি স্টেটের সিংহাসনে অভিষেক হয় গুলাব সিংহের প্রপৌত্র হরি সিংহ। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের সময়ে হরি সিংহ-ই ছিলেন ক্ষমতায়। কিন্তু জম্মু কাশ্মীর কোন দিকে যাবে, ভারত না পাকিস্তান, সে প্রশ্নে নিরপেক্ষ অবস্থান নিয়েছিলেন তিনি।

কিন্তু নিজের অবস্থান পাল্টাতে বাধ্য হন হরি সিংহ। তৎকালীন নর্থ ওয়েস্ট ফ্রন্টিয়ার প্রভিন্স বা আজকের খাইবার পাখতুনখোয়া থেকে আসা পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে তাড়াতে তার প্রয়োজন ছিল ভারতের সেনা-সাহায্য। ফলস্বরূপ ১৯৪৭-এর ২৬ অক্টোবর ইনস্ট্রুমেন্ট অব অ্যাসেশন স্বাক্ষর করেন মহারাজা হরি সিংহ।

স্বাধীন ভারতের জন্মলগ্ন থেকেই উপত্যকায় শুরু হল ভারত-পাকিস্তান দ্বন্দ্ব। ১৯৪৮ সালে কাশ্মীর সমস্যা নিয়ে রাষ্ট্রপুঞ্জের নিরাপত্তা পরিষদে যায় ভারত। রাষ্ট্রপুঞ্জের নির্দেশ, কাশ্মীরের মানুষের মন বুঝতে গণভোট হোক। পাশাপাশি সেনা সরাতে হবে পাকিস্তানকে। উপত্যকায় ভারতীয় সেনা থাকবে ন্যূনতম। বজায় থাকবে সংঘর্ষ বিরতি। সেনা প্রত্যাহারে অসম্মত হয় পাকিস্তান।

১৯৪৯ সালে পরিস্থিতির চাপে হরি সিংহ কাশ্মীর ছাড়েন। ক্ষমতা যায় ন্যাশনাল কনফারেন্স পার্টির নেতা শেখ আবদুল্লার হতে। তিনি ছিলেন জম্মু কাশ্মীরের ‘দ্বিতীয় প্রধানমন্ত্রী’।

১৯৫১ সালে জম্মু কাশ্মীরে বিধানসভা ভোট হয়। ভারতের বক্তব্য ছিল এরপর গণভোট নিষ্প্রয়োজন। কিন্তু উপত্যকাবাসীর মনোভাব বুঝতে গণভোটের প্রশ্নে অটল রাষ্ট্রপুঞ্জ ও পাকিস্তান। গণভোটের পক্ষে মত দেওয়ায় ১৯৫৩ সালে বরখাস্ত ও গ্রেফতার হন কাশ্মীরের তৎকালীন ‘প্রধানমন্ত্রী’ শেখ আবদুল্লাহ। ফলে ভারতে অন্তর্ভুক্তিতে বিলম্ব। জম্মু কাশ্মীরের নতুন সরকার কাশ্মীরের ভারত-ভুক্তিকে অনুমোদন দেয়।
জওহরলাল নেহরুর পূর্ণসমর্থনপ্রাপ্ত অস্থায়ী সংস্থান অনুচ্ছেদ ৩৭০-এর তীব্র বিরোধিতা করেছিলেন শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়। ভারতীয়দের পারমিট নিয়ে কাশ্মীর প্রবেশের প্রতিবাদে সোচ্চার ছিলেন তিনি। ১৯৫৩ সালে এই নিয়ম ভেঙে কাশ্মীরে প্রবেশ করতে গিয়ে শেখ আবদুল্লা সরকারের হাতে গ্রেফতার হন। কাশ্মীরে বন্দি অবস্থায় তার রহস্যমৃত্যু হয় ১৯৫৩ সালের ২৩ জুন। তার আন্দোলনের জেরে লুপ্ত হয় কাশ্মীরের পারমিট প্রথা।

১৯৫৭ সালে ভারতের অংশ হিসেবে সাংবিধানিক স্বীকৃতি পায় জম্মু কাশ্মীর। ১৯৫৪ সালের রাষ্ট্রপতির নির্দেশে সংবিধানের ৩৫-এ অনুচ্ছেদ যোগ করা হয়েছিল। সোমবার রাষ্ট্রপতির সাংবিধানিক নির্দেশিকায় খারিজ হয়ে গেল ৩৫-এ অনুচ্ছেদ। তার আগে ২০১৮-র জুন মাস থেকে ছ’মাস রাজ্যপালের শাসনের পরে জম্মু কাশ্মীরে রাষ্ট্রপতির শাসন চলছিল।

রাজ্যসভায় পাশ হয়েছে রাজ্যের পুনর্গঠন বিলও। লোকসভায় পাশ হলে রাষ্ট্রপতি নির্দেশিকা জারি করে ঘোষণা করবেন, ৩৭০ অনুচ্ছেদের প্রথম ধারা বাদে বাকি অংশ কার্যকরী থাকছে না। ফলে রাজ্যের তকমা হারানোর মুখে জম্মু-কাশ্মীর। এবার থেকে হতে চলেছে দু’টি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল। জম্মু কাশ্মীর এবং লাদাখ। এই কাশ্মীরই মূলত ভারত-পাকিস্তানের দ্বন্দ্বের মূল কারণ।
১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্ত হওয়ার পর থেকে রাষ্ট্র দুটির মধ্যে দ্বন্দ্ব লেগেই আছে। মজার বিষয় হচ্ছে, দুই দেশই মনে করে কাশ্মীর তাদের অংশ।

কাশ্মীর ইস্যুতে সর্বশেষ যুদ্ধটি হয় ১৯৯৯ সালে। সেসময় পাকিস্তান লাইন অব কন্ট্রোল পেরিয়ে ভারতের কার্গিল এলাকা দখল করে নিয়েছিল। অবশ্য পরবর্তীতে আন্তর্জাতিক চাপের মুখে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয়ী'র সঙ্গে আলোচনা করে সেনা প্রত্যাহার করে নেয় পাকিস্তান।

১৯৪৭ সালে দেশ দুটি বিভক্ত হবার সময়ই কাশ্মীর সমস্যার সমাধান চেয়েছিলেন ব্রিটিশ শাসক। তখন কাশ্মীরের রাজা হরি সিংহকে না পাওয়ায় অসমাপ্ত থেকে যায় কাশ্মীর ইস্যুর সমাধান। আর শুরু হয় দুই সহদর রাষ্ট্রের দ্বন্দ্বের অধ্যায়। যা চলমান।

বর্তমানে কাশ্মীর এলাকা ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে বিভক্ত হয়ে আছে এবং এর একটি ক্ষুদ্র এলাকা চীনের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। পাকিস্তান ও ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্ক রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের। অন্যদিকে চীনের সঙ্গে পাকিস্তানের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। কাশ্মীরের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে রয়েছে চীনের সীমানা। ভারত মনে করে, চীন সরকার পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে ইসলামাবাদের অবস্থানকে শক্তিশালী করার জন্য দেশটিকে সহায়তা করছে এবং চীন ও পাকিস্তান আজাদ কাশ্মীর এলাকায় যৌথ নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক পরিকল্পনা বাস্তবায়নের চেষ্টা করছে। ফলে পারস্পরিক অবিশ্বাস ও উভয় দেশের কৌশলগত অবস্থানের কারণে কাশ্মীর সংকটের সমস্যার সমাধান আরো জটিল হয়ে যাচ্ছে। এছাড়াও এই বিরোধপূর্ণ কাশ্মীর অঞ্চল- যার প্রায় দুই তৃতীয়াংশ রয়েছে ভারতের নিয়ন্ত্রণে। এক তৃতীয়াংশকে পাকিস্তান নিয়ন্ত্রণ করে আজাদ কাশ্মীর নামে। এই অঞ্চলটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এবং এর অধিকাংশ মানুষই ভারতের সঙ্গে থাকতে চায় না বলে পাকিস্তান বলে আসছে। এমন পরিস্থিতিতে সংবিধানের ৩৭০ ধারা বাতিল করে কাশ্মীরের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিল ভারত। এ পর্যন্ত পাক-ভারত দ্বন্দ্বের সংক্ষিপ্ত চিত্র উপস্থাপন করা হলো।

১৯৪৭
পৃথক হবার পর ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে এটিই ছিল প্রথম যুদ্ধ। এটিকে প্রথম কাশ্মীর যুদ্ধও বলা হয়। ১৯৪৭ সালের ২১ অক্টোবর শুরু হয়ে এ যুদ্ধ চলে ১৯৪৮ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত। প্রায় ১৪ মাস চলা এ যুদ্ধের সমাপ্তিতে যুদ্ধবিরতি গণভোটের আয়োজন করে জাতিসংঘ। এ যুদ্ধে লাইন অব কন্ট্রোল পার হয়ে কাশ্মীর ও জম্মুর প্রায় এক তৃতীয়াংশ নিয়ন্ত্রণে নেয় পাকিস্তান। এর ফলে জম্মু ও কাশ্মীর (প্রায় ১০১.৩৮৭ বর্গ কিলোমিটার) ও পাকিস্তান অঞ্চলে যা পরবর্তীতে আজাদ কাশ্মীর নামে পরিচিতি পায়; (১৩,৩৯৭ বর্গ কিলোমিটার) এবং উত্তরাঞ্চল (৭২,৪৯৬ বর্গ কিলোমিটার) হয়ে ওঠে ভারত রাষ্ট্র।

১৯৬৫
ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে কাশ্মীর ইস্যুতে দ্বিতীয়বারের মতো যুদ্ধ হয় ১৯৬৫ সালে। ওই বছর আগষ্টের শেষের দিকে শ্রীনগর সিমান্তে প্রবল বিক্রমে আক্রমণ করে পাকিস্তান। হতচকিত ভারত কিছু বুঝে ওঠার আগেই পাকিস্তানী সেনাবাহিনী যুদ্ধবাজ উপজাতিগুলোর সহায়তায় শ্রীনগরের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে যায়। মেজর জেনারেল আখতার হোসেন মালিকের অধিনায়কত্বে পাকিস্তান সেনাবাহিনী আখনুর ও জারিয়ান দখল করে নেয়। পরে ৬ই সেপ্টেম্বর খেমকারান সেক্টর দিয়ে ভারত করাচি আক্রমন করে বসে। আয়ুবের তখন ত্রাহি অবস্থা, আয়ুব কখনও ভাবতে পারেনি ভারত শ্রীনগর যুদ্ধকে আন্তর্জাতিক সীমান্তে টেনে নেবে। পাকিস্তানি সমস্ত ইউনিট তখন হয় শ্রীনগর নাহয় শ্রীনগর অভিমুখে। ওই রাতেই আয়ুব খান ম্যাগের কমান্ড নিজ হাতে তুলে নেন, শ্রীনগর অভিমুখী সেনা ইউনিট ঘুরিয়ে খেমকারান সেক্টরে এসে ভারতীয় আক্রমণ প্রতিহত করার নির্দেশ দেন। দু’দেশের দ্ব›দ্ব যখন চরমে তখন আন্তর্জাতিক মহলের হস্তক্ষেপে তাশখন্দ চুক্তির মাধ্যমে এ যুদ্ধ বন্ধ করা হয়।

১৯৭১
১৯৭১ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ ছিল ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সংঘটিত একটি সামরিক যুদ্ধ। ওই বছর ৩রা ডিসেম্বর ১১টি ভারতীয় এয়ারবেসে পাকিস্তান আচমকা হানা দিলে অপারেশন চেঙ্গিস খাঁ নামে এই যুদ্ধ শুরু হয়। ৩ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত মাত্র তেরো দিনের এই যুদ্ধ ইতিহাসের স্বল্পদৈর্ঘের যুদ্ধগুলোর মধ্যে একটি।

১৯৯৯
১৯৯৯ সালের মে-জুলাই মাসে কাশ্মীরের কার্গিল জেলায় ভারত ও পাকিস্তান রাষ্ট্রের মধ্যে সংঘটিত একটি সশস্ত্র সংঘর্ষ। পাকিস্তানি ফৌজ ও কাশ্মীরি বিচ্ছিন্নতাবাদীরা উভয় রাষ্ট্রের মধ্যে ডি-ফ্যাক্টো সীমান্তরেখা হিসেবে পরিচিত নিয়ন্ত্রণ রেখা বা লাইন অব কন্ট্রোল পেরিয়ে ভারতে ঢুকে পড়লে এই যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে ওঠে। মে থেকে জুলাই পর্যন্ত স্বল্প সময়ের এ যুদ্ধে পাকিস্তান লাইন অব কন্ট্রোল পেরিয়ে ভারতের কার্গিল এলাকা দখল করে নিয়েছিল। অবশ্য পরবর্তীতে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয়ী'র সঙ্গে আলোচনা করে সেনা প্রত্যাহার করে নেয় পাকিস্তান।

২০০৩ সালে দুই দেশের মধ্যে অস্ত্রবিরতি চুক্তি হয়। কিন্তু এরপরও প্রায়শ উভয় দেশ পরস্পরের বিরুদ্ধে চুক্তি লঙ্ঘনের অভিযোগ করে আসছে। সীমান্তে নিয়মিত চলছে গোলাগুলি। এরপর ২০১৬ ও ২০১৮ সালেও কয়েকবার পরিস্থতি উত্তাল হয়ে ফের শান্ত হয়েছে। কিন্তু এবার ভারতের কঠিন সিদ্ধান্ত আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকদের চিন্তার ভাঁজ খানিকটা গাঢ় করেছে।  কে জানে, হয়তো আরেকটি যুদ্ধের দিকেই এগোচ্ছে বিপরীত মেরুতে চলা রাষ্ট্রদুটি।



দৈনিক প্রভাতী/আরআর
 

Provaati
    দৈনিক প্রভাতী
    এই বিভাগের আরো খবর