রোববার   ২৪ নভেম্বর ২০২৪ |  অগ্রাহায়ণ ১০ ১৪৩১ |   ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

সিঙ্গাপুরে গড়েছে অপরাধের সামাজ্র্য

অনিয়ম ও দুর্নীতি`র বরপুত্র হন্ডি জামান

বিশেষ প্রতিনিধি  :: 

প্রকাশিত: ১ অক্টোবর ২০২৪ ১৯ ০৭ ৪৭  

এম বদিউজ্জামান

এম বদিউজ্জামান

ব্যাংকিং খ্যাতের অন্যতম ব্যক্তি এম বদিউজ্জামান। এ খাতের অনিয়ম ও দুর্নীতি'র বরপুত্র ছিলেন তিনি। ব্যাংকার হওয়া সুবাদে জড়িয়ে পড়েছিলেন হন্ডি ব্যবসায়। পরে বিদেশে পালিয়ে গিয়ে স্বর্ণ চোরাচালানে জড়িয়ে পড়েন।  ১/১১ পর থেকে ২০২২ পর্যন্ত নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ থাকলেও  তিনি ছিলেন ধরাছোঁয়ার বাহিরে। পরে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জন ও বিদেশে অর্থ পাচারের অভিযোগে দুদকে মামলা হওয়ায় গাঁ ঢাকা দেন। আওয়ামীলীগ সরকারকে ব্যবহার করে অনৈতিক ভাবে আঙ্গুল ফুলে গাছ হয়ে যাওয়া এম বদিউজ্জামান (হন্ডি জামান)  এখন লোক চক্ষুর আড়ালে। এম বদিউজ্জামান (হন্ডি জামান)  এখন কোথায়? এমন প্রশ্নে প্রশাসন ও রাজনৈতিক ও গণ্যমাধ্যমকর্মীদের মধ্যে ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে।  তার  বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) একাধিক অভিযোগের পাশাপাশি  দুদক পক্ষ থেকে দুটি মামলাও রয়েছে।  অভিযোগ ও মামলায় বদিউজ্জামানের দুই স্ত্রী, ছেলেসহ ৬ জনের নামও রয়েছে।

দৈনিক যায়যায়দিনের অনুসন্ধানে যায় গেছে, অবৈধ সম্পদ অর্জন ও বিদেশে অর্থ পাচারের অভিযোগে থাকায় দীর্ঘদিন ধরে এম বদিউজ্জামান সিঙ্গাপুরে লুকিয়ে রয়েছে। বাংলাদেশ থেকে পাচারের টাকায় সিঙ্গাপুরে গড়ে তুলেছেন নিজের সাম্রাজ্য। সিঙ্গাপুরের ৩নং রোবার্টস রোডে বদিউজ্জামানের নামে রয়েছে জামান সেন্টার। জামান সেন্টারে "হোটেল সিঙ্গাপুর ইন"পরিচালনার পাশপাশি স্বর্ণ ও অর্থ পাচার করে যাচ্ছেন তিনি। বাংলাদেশ থেকে সিঙ্গাপুরে যাতায়াতকারী অধিকাংশ ব্যবসায়ী তাকে " হন্ডি জামান" নামেই চিনেন। এছাড়াও আওয়ামীলীগ সরকার পতনের পর  তার সেখানে  কয়েক প্রভাবশালী নেতা আশ্রয় নিয়েছে বলে একাধিক সূত্র নিশ্চিত রয়েছে। সূত্র জানিয়েছেন, বেনজীরের আহমেদের অধিকাংশ অর্থ বিদেশে পাচার হয়েছে বদিজ্জামানের হাত হয়ে । তিনি বেনজিরের একাংশের ব্যবসায়িক পার্টনারও ছিল। এসব অভিযোগ সম্পর্কে  এম বদিউজ্জামানের বক্তব্য জানতে সিঙ্গাপুর লোকাল মোবাইল ফোন নম্বরের যোগাযোগ করা হয়। তিনি অসুস্থ্যতার কথা ফোন কেটে দেন। পরে বার বার কল দেয়া হলেও নম্বরটি বন্ধ পাওয়া যায়।

দুদক সূত্র জানিয়েছে, এম বদিউজ্জামান তার দুই ছেলে নাফিহ রশিদ খান ও নাভিদ রশিদ খান এবং বদিউজ্জামানের দুই স্ত্রী নাসরিন জামান ও তৌহিদা সুলতানাসহ তার আত্নীয়ের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অনিয়ম-দুর্নীতিসহ অবৈধ উপায়ে সম্পদ অর্জনের গুরুত্বর অভিযোগ রয়েছে । তারা বিভিন্ন সময় বিভিন ব্যাংকের বিপুল অঙ্কের শেয়ার ক্রয়সহ মানি লন্ডারিংয়ের মাধ্যমে বিদেশে অর্থ পাচার করেছে । দুর্নীতি ও অর্থ পাচারের আমলযোগ্য তথ্য-প্রমাণ থাকায় দুদক কমিশন সমন্বিত জেলা কার্যালয় ঢাকা-১ মামলা দুটি করা হয়।

দুদক সূত্র  আরো জানিয়েছেন, শুধু মাত্র শেয়ার কেনাবেচায় অনিয়মের মাধ্যমে  শত কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে  এম বদিউজ্জামান ও সহযোগীরা । এম বদিউজ্জামান  অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে অ্যাডভান্স হোম প্রাইভেট লিমিটেড ও ফিনিক্স লিমিটেডের বিপুল অঙ্কের শেয়ার কেনা, মানি লন্ডারিং করেছেন। এছাড়াও কালো টাকার ব্যবসায় তার সম্পৃক্ততার অভিযোগ রয়েছে। 

দুর্নীতি দমন কমিশন একজন সহকারি পরিচালক জানান, ২০২২ সালে এম বদিউজ্জামান বিরুদ্ধে বেশ কিছু গুরুত্বর অভিযোগ উঠে। তার বিরুদ্ধে দুজন'সহকারি পরিচালক ব্যাপক অনুসন্ধান চালায়। প্রাথমিক তারা অভিযোগের তথ্যের সত্যতা প্রমান পান। যার প্রেক্ষিতে দুদকের ঐ দুজন সহকারি পরিচালক বাদী হয়ে শুধুমাত্র বদিজ্জামানের বিরুদ্ধে একটি মামলা এবং  তার স্ত্রীসহ আরো ৬ জনের বিরুদ্ধে আরো একটি মামলা করেন। বিষয়টি নিয়ে এখনো আমরা কাজ করে যাচ্ছে । 

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছেন, এম বদিউজ্জামানের (হন্ডি জামান) বাংলাদেশে কয়েকজন সহযোগী রয়েছে।  তারা মূলত বিভিন্ন কৌশলে হুন্ডির মাধ্যমে সিঙ্গাপুরে টাকা পাঠাই। দেশ থেকে যারা বিদেশ টাকার পাচার করতে চাই এ সকল ব্যবসায়ী ও রাজনৈতিক ব্যক্তিদের সঙ্গে ৫ থেকে ১০% কমিশনের চুক্তি করে তারা । পরে সেই মোতাবেক তারা বাংলা টাকা বুঝে নিয়ে সিঙ্গাপুরী ডলার বা ইউএস ডলার বুঝিয়ে দেয়া হয়। সিঙ্গাপুরসহ একাধিক দেশে হুন্ডি ব্যবসার অন্যতম অংশীদার বদিউজ্জামানের স্ত্রী তানিয়া জামান। সার, কীটনাশক ও অন্যান্য কৃষিপণ্যের কাঁচামাল আমদানি-রপ্তানির নামে ওভার ইনভয়েস করে অর্থ পাচার করেন। এসবের এবিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটে (বিএফআইইউ) রয়েছে একাধিক প্রমাণ। এছাড়াও সিঙ্গাপুর থেকে যারা দেশে ফিরে  বদিউজ্জামান (হন্ডি জামান) তাদের প্রলোভনে ফেলে স্বর্ণ চোরাচালান করে দেশে। প্রবাসীরা দেশে ফেরার সময় কখন কখন বিমানের অর্ধেক ভাড়া প্রদান, আইফোন উপহারসহ নানা প্রলোভন দেখিয়ে স্বর্ণ চোরাচালানে বাধ্য করেন। তার এ কাজের সহযোগী করেন সিঙ্গাপুরে স্থানীয় আরভিন রাথোর নামের একজন সহযোগী। এছাড়াও রাজধানীর ঢাকার তাঁতী বাজারের কয়েকজন স্বর্ণ ব্যবসায়ীর মাধ্যমে দেদারছে স্বর্ণ পাচার করে যাচ্ছেন। 

প্রাপ্ত তথ্য মতে, বদিউজ্জামান ও স্ত্রী ও ছেলেদের নামে বসন্ধুরা আবাসিক এলাকয় রয়েছে  তিনটি প্লট। যার আনুমানিক বাজার মূল ৪০ কোটি টাকা।  গুলশানে রয়েছে একটি ফ্লাট যার দাম ৭ কোটি টাকা।  বনানীতে রয়েছ অ্যাডভান্স রাইটস নামে বহুতল ভবন। যার দাম ৬৫ কোটি টাকা। জোয়ারসাহারায়  রয়েছে দুটি  ৯ তলা আবাসিক ভবন। যেগুলোর আনুমানিক মূল্য ৩০ কোটি টাকা।  উত্তরায় বহুতল ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। যার বর্তমান বাজারমূল্য দশ কোটি টাকা। গোপালগঞ্জ জেলা সদরে প্রায় ৩৫০ বিঘা জমিতে রয়েছে দুটি আবাসিক প্রকল্প- অ্যাডভান্স নিরালা ও অ্যাডভান্স সুগন্ধা। এগুলোর বর্তমান বাজারমূল্য প্রায় ১৫০ কোটি টাকা। গোপালগঞ্জ সদরে সার্কিট হাউস রোডে রয়েছে নিজের নামে বিলাসবহুল আবাসিক বাড়ি, যার বর্তমান বাজারমূল্য প্রায় দশ কোটি টাকা। এছাড়াও বিভিন্ন বাণিজ্যিক এলাকায় তারা নানা প্লট, ফ্ল্যাট, জমি-জমা সম্পত্তি কিনেছেন। নামমাত্র জামানতের বিপরীতে শত শত কোটি টাকার ব্যাংক ঋণ নিয়ে নরসিংদীতে বিশাল আকারের ফ্যাক্টরি ও খামার গড়ে তুলেছেন। নামে-বেনামে চট্টগ্রাম বন্দরের পাশে কয়েকশ বিঘা জমি কিনেছেন। জাহাজের ছোট ছোট বোট চালানোর ডকইয়ার্ডও রয়েছে তাদের।

সিআইডির অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (মিডিয়া) আজাদ রহমান জানান, মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন ও বিধি মোতাবেক প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করে থাকে সিআইডি । এম বদিজ্জামানের একটি ব্যাংকের পরিচালক থাকাকালিন তার বিরুদ্ধে ব্যাপক অভিযোগ ছিল।  যেহেতু  তার বিষয় নিয়ে দুদক কাজ করছে। প্রয়োজনে দুদককে সহযোগীতা করতে ইন্টাপোলের মাধম্যে দেশে ফিরে এনে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। 

এই বিষয়ে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন,  দেশ থেকে প্রতিনিয়ত সুকৌশলে অর্থ পাচার হয়ে যাচ্ছে। যা অনেকটাই ধরাছোঁয়ার বাহিরে। এক্ষেত্রে অপরাধীরা কোনো ডকুমেন্টেশন  রাখে না।  যাদের বিরুদ্ধে এই ধরণের অভিযোগ রয়েছে দুদকের উচিত যে কোনো মূলে বিচারের মুখামুখি করা।  তিনি আরো জানান, তথ্য প্রমাণ ও  মামলা থাকার পরও সংশ্লিষ্টদের অবহেলার কারণে অপরাধীরা বিদেশে পালাতে সক্ষম হচ্ছে। তাই দুদকসহ সংশ্লিষ্ট প্রশাসনকে আরো  নজরদারি বাড়াতে হবে। 

বদিউজ্জামান (হন্ডি জামান) নিজ এলাকা গোপালগঞ্জের একজন আত্নীয় নাম প্রকাশ না করার শর্তে এ প্রতিবেদককে জানান, এম বদিউজ্জামানের সঙ্গে এলাকার মানুষ জনের সম্পর্ক ভালো না। এলাকার বেশ কয়েক যুবকদের চাকুরী দেয়ার নাম করে বিদেশে নিয়ে গেছে। কিন্তু কাজ না পেয়ে তাদের দেশে ফিরে আসতে হয়েছে। এছাড়াও তার প্রলোভনে পড়ে অনেকেই বিদেশে গেছে। মূলত্য  অবৈধভাবে ও অবাধে আদম ব্যবসা করছেন। গোপালগঞ্জ সদরে তার বহুতল একটি ভবন রয়েছে। সেখান থেকে তিনি শেখ সেলিমকে দুটি ফ্লোর উপহার দিয়েছেন এইটা এলাকার সবাই জানেন। এখন তার আত্নীয় হিসেবে পরিচয় দিতে লজ্জা লাগে বলে তিনি মন্তব্য করেন। 

Provaati
    দৈনিক প্রভাতী
    এই বিভাগের আরো খবর