রোববার   ২৪ নভেম্বর ২০২৪ |  অগ্রাহায়ণ ১০ ১৪৩১ |   ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

নাম তার কিশোর কুমার গাঙ্গুলি

প্রকাশিত: ৪ আগস্ট ২০১৯ ১৭ ০৫ ০১  

নাম-তার-কিশোর-কুমার-গাঙ্গুলি

নাম-তার-কিশোর-কুমার-গাঙ্গুলি

(জন্ম ৪ অগাস্ট, ১৯২৯। মৃত্যু ১৩ অক্টোবর, ১৯৮৭। মাত্র ৫৮ বছরের সংক্ষিপ্ত জীবন। কিন্তু চূড়ান্ত বর্ণময়। একাধারে গায়ক, নায়ক, প্রযোজক, পরিচালক। অন্যদিকে প্রেমিক, পাগল, বিনয়ী, সাধক। গুণ ও কীর্তির চূড়ান্ত সমাহার। একেই বোধহয় শিল্পী বলে। প্রথাগত নিয়মের বাইরে বিচরণ সর্বদা। কিন্তু উৎকর্ষের শীর্ষে অবস্থান। আজ তার একানব্বইতম জন্মবার্ষিকী। আজও তিনি চিরতারুণ্যের প্রতীক। নবীন প্রজন্মের হৃৎস্পন্দন। আজ স্মরণ তাকে)

সালটা ১৯৮৫। তখন মোবাইল আসেনি। ক্যামেরায় ফিল্ম ভরে ছবি তুলতে হয়। ট্রাঙ্ক কলের যুগ। পোস্ট কার্ড ইন ল্যান্ডের যুগ। লাল লিপস্টিকের ঠোট রাঙানো প্রেম পত্রের যুগ। আর যুগটা তারুণ্যে পা দেয়া ছেলে মেয়েদের কাছে কিশোর কুমারের। সেই সময়ে বিশেষ কাজে ইন্দোর যেতে মধ্য রাতে নেমেছিলাম খান্ডোয়া স্টেশনে। খান্ডোয়া নেমে বাসে ইন্দোর যাওয়াই দ্রুততম ব্যবস্থা। হোটেলে রাত কাটিয়ে সকালে একজনকে এখানকার দ্রষ্টব্য স্থান জিজ্ঞাসা করতেই তিনি বললেন– গাঙ্গুলি হাউজ। অশোককুমার, কিশোরকুমারের বাড়ি। টাঙ্গা নিয়ে চললাম পুণ্যস্থান দর্শণে। নিজের জন্মস্থান খান্ডোয়া নিয়ে খুব গর্ব ছিল কিশোরকুমারের। পরিচয় দেয়ার সময় বলতেন খান্ডোয়ার কথা। গানের কথায়, সিনেমার সংলাপেও সুযোগ পেলেই ঢুকিয়ে দিতেন খান্ডোয়ার নাম। শুধু কিশোর কুমার নন, তার বড় দাদা তথা প্রয়াত অপর কিংবদন্তি নায়ক অশোক কুমারের শৈশব কেটেছে খান্ডোয়ার গাঙ্গুলি হাউসে। কিশোরকুমার বহু সময় সপরিবার ছুটি কাটিয়েছেন খান্ডোয়ার এই বাড়িতে৷ পরে তিনি নিজের অংশ মেজদা অনুপকুমারের কাছে হস্তান্তর করে দেন৷ দেখলাম কিশোর কুমারের সেই জন্মভিটে। তখনো প্রায় সময় সপরিবার ছুটি কাটাতে আসতেন খান্ডোয়ার এই বাড়িতে৷ তখন গাঙ্গুলি হাউসে মোট ১৪টি ঘর ছিল ৷ এছাড়া বাড়ির কিছু অংশ নিয়ে ১৩টি দোকান চলত৷ এখানেই জন্মেছিলেন আভাস কুমার গঙ্গোপাধ্যায় ওরফে কিশোরকুমার। তার বাবা কুঞ্জলাল গাঙ্গুলি ছিলেন একজন আইনজীবী। মায়ের নাম গৌরী দেবী। চার ভাই বোনের ভিতর কিশোর ছিলেন সর্বকনিষ্ঠ।

ছোটবেলায় কিশোরের কণ্ঠে সুর তো ছিলই না, উপরন্তু গলা ফ্যাসফ্যাসে ছিল । চার বছর বয়সে তার পায়ের আঙুল কেটে যায় । চার দিন ধরে নাগাড়ে এমন অসহ্য যন্ত্রণা ছিল যে, এই চারদিন ছোট্ট কিশোর সমানে চেঁচিয়ে কেঁদে গেলেন। সেই চেঁচানিতে বাড়িতে অস্বস্তি ও উৎকণ্ঠা বাড়লেও, তাঁর গলা গেল খুলে, ফ্যাসফেসে ভাব গেল কেটে।  

কিশোরের যখন সবে যৌবন, তখনই দাদামনি অশোককুমার হয়ে উঠেছিলেন মস্ত বড় গায়ক-নায়ক স্টার। দাদামনির ফিল্মের গান কিশোর তখন খুব করে গাইতেন।দাদামনির ডাকে এলেন বোম্বে। দাদামনির সাহায্য ও ইচ্ছেতেই ছায়াছবিতে কিশোরের প্রথম অভিনয়। অশোক কুমার অভিনীত 'শিকারি'(১৯৪৬) ছবিতেই অভিনয়ে হাতেখড়ি হয় কিশোরের। এ-ছবিতে তিনি এক মালির চরিত্রে অভিনয় করেন। কিছুদিন পরে বম্বে টকিজের বাঁধাধরা মিউজিক ডিরেক্টার খেমচাঁদ প্রকাশ কিশোরকে দিয়ে খেমচাঁদ প্লেব্যাক করালেন তার সুরে 'জিদ্দি'(১৯৪৮) ছবিতে- 'মরনে কি দুয়ায়েঁ' গানে। এখান থেকেই আভাষ কুমার হয়ে গেলেন কিশোর কুমার। কিন্তু তাও ফ্লপ। তাই গায়ক নয়,দাদামনি চাইলেন ভাইকে নায়ক হিসেবে তুলে ধরতে। এই পর্বটা বিচ্ছিরিভাবে কাটল কিশোরের। এই সময় তিনি একসঙ্গে বাইশখানা ছবিতে কাজ করলেন, তার মধ্যে ষোল খানা ছবিই ফ্লপ করল। প্রযোজকেরা এককাট্টা হয়ে ঠিক করলেন যে, আর কিশোরের সঙ্গে তাঁরা কাজ করবেন না। ফলে তার নায়কজীবন নিয়ে দেখা দিল চরম সংকট। আর এইসময়ই তিনি ভালোবেসে বিয়ে করলেন রুমা গুহঠাকুরতাকে। কিন্তু রুমা ব্রাহ্ম বলে বাড়িতে এমন অশান্তি শুরু হল যে, বম্বে টকিজ থেকে কিশোরকে সটান বের করে দেয়া হল। এতদিন কিশোর দাদামনির বাড়িতে থাকছিলেন, এবার কিশোর নিজেই সে বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন। শুরু হল অনিশ্চিত জীবনের লড়াই। নায়ক হবার দরজা বন্ধ, তাই এইসময় রুমার পরামর্শে তিনি আবার গায়ক হওয়ার সাধনা শুরু করলেন। সেই মুহূর্তে তাকে সাহায্যের জন্য হাত বাড়িয়ে দিলেন যে মানুষটি, তিনি হলেন শচীন দেব বর্মণ। ১৯৫০-এর এক সকালে শচীন দেবই প্রথম কিশোরকে পরামর্শ দিয়েছিলেন। কিশোর এরপরই তার সর্বজন পরিচিত নিজস্ব স্টাইল উদ্ভাবন করেন। সাফল্য পেলেন ‘আরাধনা’ ছবিতে।  

গায়ক কিশোরকুমার নিয়ে প্রচুর কালি কাগজ খরচা হয়েছে। কিন্তু অভিনেতা কিশোর কুমার? কমেডি চরিত্রে তিনি ছিলেন অনন্য। বাপ রে বাপ (১৯৫৫), চলতি কা নাম গাড়ি (১৯৫৮), হাফ টিকিট (১৯৬২), পড়োশন (১৯৬৮), হাঙ্গামা (১৯৭১), পেয়ার দিবানা (১৯৭৩), বাড়তি কা নাম দাড়ি (১৯৭৪) ছবিতে তিনি তার সাফল্যের স্বাক্ষর রাখেন।গানের জগতের মানুষ, অথচ ক্যামেরার পিছনে দাঁড়িয়েছেন, খুব বেশি নেই। ভূপেন হাজারিকা, হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ও বিশাল ভরদ্বাজ। ভূপেন ও বিশাল পরিচালিত ছবি জাতীয় পুরস্কার পেয়েছে। একদা হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ‘অনিন্দিতা’ নামের একটি ছবি পরিচালনা করেছিলেন। দর্শকের দরবারে বিশেষ পাত্তা পায়নি। কিন্তু কিশোরকুমারবারোটি ছবি পরিচালনা করেন, তার মধ্যে আটটি মুক্তি পায়। একাধিক কমেডি ফিল্ম, কিশোর-ঘরানার উদ্ভট রসের চূড়ান্ত, এবং তার রূপায়ণে পরিচালক স্বয়ং। তবে এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘চলতি কা নাম জিন্দেগি’, ‘চলতি কা নাম গাড়ি’-র সিকোয়েল হিসেবে। সেই তিন ভাইয়ের গল্প, অভিনয়েও অনুপ-অশোক-কিশোর, কিন্তু ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হয়নি। যে তিনটি ছবি তাঁকে পরিচালক হিসেবে বিশিষ্টতা দিয়েছে কিছুটা, সেগুলির মধ্যে কিশোরীয় রঙ্গরসিকতা সম্পূর্ণ অনুপস্থিত— ‘দূর গগন কি ছাওঁ মেঁ’, ‘দূর কা রাহি’ এবং ‘দূর ওয়াদিয়োঁ মেঁ কহিঁ’। দূর কা রাহি’ চলেছিল ১৫ সপ্তাহ। কিশোর নাকি নিজেই গিয়ে পরিবেশকদের বলতেন এ ছবি না কিনতে— ‘ ইয়ে বোরিং ফিল্ম হ্যায়’। তবে তাঁর পরিচালিত প্রথম ছবি ‘দূর গগন কি ছাওঁ মেঁ’ রীতিমতো জনপ্রিয় হয়েছিল, দর্শক এবং সমালোচক, উভয় মহলেই। কিশোর স্বয়ং বলেছেন কী ভাবে এ ছবি হিট হল। যে দিন মুক্তি পায়, ‘অলঙ্কার’ সিনেমা হলে সে দিন দশ জন দর্শক, কিশোর কুমার সহ। আট সপ্তাহের জন্য হলটা বুক করেছিলেন আর এক পরিচালক সুবোধ মুখোপাধ্যায়, তার ছবি ‘এপ্রিল ফুল’ রিলিজের জন্য। কিশোরের আত্মীয় এই ভদ্রলোক দয়া করে কিশোরকে এক সপ্তাহের জন্য হল ধার দেন। দু’জনই নিশ্চিত ছিলেন যে ‘দূর গগন কি ছাঁও মেঁ’ তার থেকে বেশি চলতে পারে না। হল তার উল্টো। ধীরে ধীরে দর্শক এতই বেড়ে গেল যে ‘এপ্রিল ফুল’ হলই পেল না, কিশোরের প্রথম সিনেমাই চলল পুরো আটসপ্তাহ। অমিতকুমার একটি সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন, ছবিটিমোট ২৪ সপ্তাহ চলে। ২৫ সপ্তাহ পর্যন্ত চালানো যায়নি, কারণ কিশোর রৌপ্যজয়ন্তীর প্রচার বাবদ খরচা জোগাতে রাজি ছিলেন না। এই ছিলেন কিশোরকুমার।

কিশোরকুমার খুশি ছিলেন তার গায়ক সত্ত্বায়। জীবনকে তিনি নিয়েছিলেন এক চুড়ান্ত রসিকতা হিসেবে। তবে তার মধ্যেও তার ভদ্রতাবোধ ছিল দেখার মত। ‘পড়োশন’ ছবির সেই বিখ্যাত গান ‘এক চতুর নার করকে শৃঙ্গার’-এর রেকর্ডিং যখন হয় তখন সব কিছু ঠিকঠাক।  রেকর্ডিংয়ের আগের দিন কিশোর কুমার বেঁকে বসলেন, এই গান তিনি কিছুতেই গাইবেন না।  মান্না দে-র সঙ্গে ডুয়েট গান। খুব চেপে ধরতে তিনি মান্না দে’কে বললেন, “কী করে গাইব বলুন তো? আমি কি আপনার মতো ক্ল্যাসিকাল জানি? পঞ্চম ঢেলে সব ভাল কাজকর্ম আপনার জন্যে করে দিয়েছে!”

তারপরে বললেন, “তা ছাড়া কেমন যেন  শুনছিলাম, এই ডুয়েট কম্পিটিশনে আমি হেরে যাব!” মান্না দে অপ্রস্তুত। তার মুখে আষাঢ় নামল। দেখে  কিশোরকুমার হো হো করে হেসে বললেন, “আপনার কাছে হারতে আমার আপত্তি নেই মান্নাদা! আমি এতক্ষণ মজা করছিলাম আপনার এমন তোম্বা মুখ দেখব বলে” এই গানের প্রসঙ্গ উঠলেই মান্না দে বলতেন, “কি গানটাই না গাইল কিশোর! এমন ইম্প্রোভাইস করল ভাবাই যায় না!” আগে চলচ্চিত্রগুলোর সিংহভাগ গান মোহাম্মদ রফি গাইতেন। রাতারাতি সেখানে ভাগ বসালেন কিশোর কুমার। এক সময় তো এমন বিতর্ক শুরু হলো যে, কে ভাল গায়ক? রফি নাকি কিশোর? ফিল্মিস্তান নামক এক ম্যাগাজিন ছিল, যেখানে পাঠকরা এ নিয়ে লিখিত বিতর্ক করা শুরু করে দিল। এরকম দুই তিন সংখ্যা চলার পর কিশোর কুমার সেখানে একটি চিঠি লিখেন এবং তাদেরকে অনুরোধ করেন যে, তাকে রফি সাহেবের সাথে যেন তুলনা না করা হয়। মোহাম্মদ রফি অনেক বড় শিল্পী। তার যে সঙ্গীত শিক্ষা,কিশোর কুমারের সেটি নেই। তিনি যেসব গান গেয়েছেন সেগুলো কি কিশোর কুমার কখনও গাইতে পারবেন? আত্মীয়তার সূত্রে সত্যজিৎ রায় ছিলেন কিশোরদার মামা। তাই তিনি মানিক মামা বলেই ডাকতেন। সিনেমায় রবীন্দ্রসঙ্গীতের ক্ষেত্রে পুরুষকণ্ঠ হিসেবে সত্যজিতের একমাত্র পছন্দ কিশোরকুমার, যাঁকে কেউ রবি-গায়ক হিসেবে আমলই দিতেন না। সত্যজিৎ রায় চারুলতা ছবিতে একটা ফ্রেশ ভয়েস চেয়েছিলেন। যে ভয়েসে কারও প্রভাব থাকবে না। একটা তরতাজা গলা। ‘চারুলতা’য় প্রথমে কিশোরকে দিয়ে গান গাওয়ানোয় সত্যজিৎ রায়কে সমালোচনার মুখেও  পড়তে হয়েছিল। সত্যজিৎ রায়ের এই ছবিগুলিতে কিশোর গেয়েছিলেন, ‘আমি চিনি গো চিনি তোমারে’ , ‘বিধির বাঁধন কাটবে তুমি’ , ‘চল রে চল সবে ভারতসন্তান’ এবং ‘বুঝতে নারী, নারী কি চায় গো’ এই চারটি গান । এর মধ্যে ‘বিধির বাঁধন কাটবে তুমি’  এবং ‘বুঝতে নারী, নারী কি চায় গো’  এই দুটি গান সত্যজিৎ রায় কিশোরকুমারকে একেবারে খালি গলায় গাইয়েছিলেন কোনরকম যন্ত্র সঙ্গীত না ব্যবহার করেই ।  এরপর হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের অনুপ্রেরনায় রবীন্দ্রসংগীতের দুটি এলবাম করেছিলেন কিশোর । সর্বমোট ২৪ টি গান । ‘একটুকু ছোঁয়া লাগে’ , ‘আমি তোমায় যত শুনিয়েছিলেম গান’, ‘সহন গহন রাত্রি’ , ‘এই কথাটি মনে রেখো’, ‘দিনের শেষে ঘুমের দেশে’ ইত্যাদি সব গান । মেগাফোন রেকর্ড কোম্পানি থেকে এলবামটি প্রকাশের সময় কোম্পানির কর্ণধার কমল ঘোষ জানিয়েছিলেন, ‘কিশোরকুমার যখন রবীন্দ্রসংগীতের এলবামটি রেকর্ডিং করছেন তখন তিনি অন্য মানুষ । যেন পূজায় বসেছেন ।’  কিশোরকুমারের এই দুটি এলবামই অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়েছিল ।

কিশোরকুমারের বাংলা বেসিক গানের সংখ্যা আনুমানিক ৬৬ টি । ‘একদিন পাখি উড়ে যাবে’, ‘আমি নেই ভাবতেই’, ‘চল যাই চলে যাই’, ‘আমার মনের ময়ূরমহলে’, ‘আমার দ্বীপ নেভানো রাত’, ‘নয়ন সরসী কেন ভরেছে জলে’ ইত্যাদি সব হিট গান যেগুলি  কিশোরকুমার গেয়েছিলেন এইচএমভি থেকে প্রকাশিত পুজোর গান হিসাবে।  এই প্রসঙ্গে মনে পড়ে যাচ্ছে, এইচএমভি থেকে প্রকাশিত  ‘রাখালচন্দ্র মাতাল’ নামক একটি গীতি আলেখ্য, যেটির কথা ও সুর স্বয়ং কিশোরকুমারের আর এই গীতিয়ালেখ্য-এর সব কটি চরিত্রেই ছিলেন স্বয়ং কিশোরকুমার । এই গীতিয়ালেখ্যটি শুনলেই বোঝা যাবে শুধু মাত্র গায়কই নন কিশোরকুমার একজন  তুখোড় বাচিক শিল্পীও বটে ।

শিং নেই তবু নাম তার সিংহ/ ডিম নয় তবু অশ্বডিম্ব/ গায়ে লাগে ছ্যাঁকা ভ্যাবাচেকা / হাম্বা হাম্বা টিকটিক টিকটিক’ বিখ্যাত এই গান কিংবদন্তি গায়ক কিশোর কুমার অভিনীত ‘লুকোচুরি’ ছবির। দেশভাগের কয়েক বছর পর মুক্তি পেয়েছিল ‘লুকোচুরি’। ছবির গল্প ছিল দুই যমজ ভাইকে নিয়ে। দুই ভাইয়ের চরিত্রেই অনবদ্য অভিনয় করেছিলেন কিশোর কুমার। আর ছবির এক দৃশ্যে ‘শিং নেই তবু নাম তার সিংহ’-তে নেচে-গেয়ে মাত করেছিলেন।গানটির গীতিকার ছিলেন গৌরী প্রসন্ন মজুমদার, সুরে ছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। ছবির দৃশ্যায়ন ও গল্প অনুযায়ী ভাবলে গানটি ছিল এক অর্থে ‘কমিক রিলিফ’। কিন্তু গানটি এই স্তরে নিয়ে গেলেন কিভাবে কিশোর কুমার?  চারের দশকে হলিউড কাঁপানো ড্যানি কে (Danny Kaye) ছিলেন কিশোরকুমারের আইডল । হলিউডের এই স্টার গায়ক অভিনেতার অভিনয়, গান গাইবার ভঙ্গী, অবিশ্বাস্য ইয়ডলিং, ম্যানারিজম কিশোরকুমার গ্রহণ ড্যানি কে- এর  ‘ও বাই জিঙ্গো‘ গানটি শুনে কিশোরকুমার এতটাই মুগ্ধ হয়েছিলেন যে লুকোচুরি ছবির ‘শিং নেই তবু নামতার সিংহ’ গানে কিশোর কুমার প্রয়োগ করেছিলেন অসাধারন সুরের ট্রান্সফরমেশন তার সাথে ছিল ড্যানি কে – এর সৃষ্ট স্টাকাটো রিদম । এভাবেই অমর হয়েছিল গানটি।  

কিশোর কুমার সম্পর্কে অনেক মজার মজার তথ্য আছে। যেমন তার ৪ সংখ্যায় বিশ্বাস। জন্ম ৪ অগাস্ট। আরো অনেক সংখ্যার সাফল্যের সাথে তিনি বলতেন যে তার স্ত্রী ছিলেন চারজন। রুমা গুহঠাকুরতা, মধুবালা, যোগিতা বালি এবং লীনা চন্দভরকর। আর ডি বর্মনের সঙ্গে সবথেকে বেশি ছবিতে কাজ। কিশোর-রাহুল দেব বর্মনের রসায়ন দেখা যায় ১৬৪টি ছবি। আর  এসডির সুরোরপিত ৪৩টি ছবিতে গেয়েছেন কিশোর। দুই পরিবারের এই অটল বাঁধুনি বেশ বিরল।  প্রযোজক, পরিচালক, সুরকার, গীতিকার,গায়ক, চিত্রনাট্যকার থেকে নায়ক। একেবারে ওয়ান ম্যান আর্মি। চারটি সিনেমায় কিশোরকুমারকে এতগুলো ভূমিকায় দেখা গিয়েছিল। সেগুলি হল, শাবাস ড্যাডি, দুর কা রাহি, দূর গগন কি চায়ো মে এবং বধতি কা নাম দাধি। কেরিয়ারে আটবার ফিল্মফেয়ার। ‘রূপ তেরা মস্তানা’ দিয়ে শুরু। শেষ পুরস্কার ‘সাগর কিনারে’ গানের জন্য। ১৯৭৫ সালে জরুরি অবস্থার সময় একমাত্র গায়ক হিসাবে কিশোরকুমারের গান নিষিদ্ধ হয়েছিল। বিবিধভারতী এবং অল ইন্ডিয়া রেডিওর দরজা বন্ধ ছিল কিশোরের। তাঁর অপরাধ,বিনা পাউসায় সঞ্জয় গান্ধীর অনুরোধে একটি অনুষ্ঠান তিনি করেননি। বক্তব্য ছিল টিকিট বিক্রি করে অনুষ্ঠান করছ তবে আমার টাকা দেবে না কেন?  মুম্বইয়ের ওয়ার্ডেন রোডের নিজের ফ্ল্যাটে ‘কিশোর হইতে সাবধান’ সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে রেখেছিলেন এই প্রবাদপ্রতিম শিল্পী। প্রযোজক-পরিচালক এইচএস রাওয়াইল একবার কিশোরের বাড়িতে গিয়েছিলেন। তার সাথে গানের ব্যাপারে দরাদরি চলছিল। তাই এই কাণ্ড।

১৯৮২ সালে নেতাজি ইনডোর স্টেডিয়ামে কিশোর নাইট। টিকিট কেটে বসলাম। স্টেডিয়ামের প্রায় সব আলো নেভানো। হালকা কাঁধ ঝাঁকিয়ে কিশোর তার বিখ্যাত গান ‘কোরা কাগজ থা ইয়ে মন মেরা, লিখ দিয়া নাম উসে তেরা’ ধরলেন। আমার চোখের সামনের আবছায়াতে উড়ে বেড়াতে লাগল জীবনে প্রথম পাওয়া প্রেমপত্র যেখানে এই গানের কথাগুলি লেখা ছিল।



দৈনিক প্রভাতী/আরআর
 

Provaati
    দৈনিক প্রভাতী