সোমবার   ২৫ নভেম্বর ২০২৪ |  অগ্রাহায়ণ ১০ ১৪৩১ |   ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

‘বন্ধুর মাকে অন্য লোকের সঙ্গে বিশ্রী অবস্থায় দেখে ফেলি! বন্ধুকে বলে দেব?’

প্রকাশিত: ৭ অক্টোবর ২০২২ ১৪ ০২ ০২  

বন্ধুর-মাকে-অন্য-লোকের-সঙ্গে-বিশ্রী-অবস্থায়-দেখে-ফেলি-বন্ধুকে-বলে-দেব

বন্ধুর-মাকে-অন্য-লোকের-সঙ্গে-বিশ্রী-অবস্থায়-দেখে-ফেলি-বন্ধুকে-বলে-দেব

আমি আর সাব্বির (ছদ্মনাম) ছোটবেলার বন্ধু। পাশের বাড়িতে থাকি। আমরা একসঙ্গে স্কুলে পড়েছি। তাই আমাদের বন্ধুত্ব বেশ জোরদার। এখন আমরা দুজনেই আলাদা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছি। যোগাযোগ ও বন্ধুত্বেও কোনো দূরত্ব তৈরি হয়নি।

কিন্তু যে ঘটনার জন্য এই চিঠি লিখতে বসা, তা কিঞ্চিৎ অদ্ভুত। সেই ঘটনা আমি কখনো কাউকে জানাইনি। জানাতে পারিনি। ঘটনাটির সঙ্গে সাব্বিরের জীবন অনেকাংশেই জড়িয়ে। কিন্তু তাকেও আমি কখনো এই ঘটনার কথা বলে উঠতে পারিনি। মনের মধ্যে একটা খচখচানি নিয়ে আজও চলেছি। মাঝে মাঝে মনে হয়  সাব্বিরকে কি বলে দেওয়া উচিত? সেই বিষয়টি জানতেই এই চিঠি।

ঘটনাটির কথায় আসা যাক। এটি আজ থেকে বেশ কয়েক বছর আগের কথা। তখন আমরা নবম শ্রেণিতে পড়ি। আরো অনেক ছোটবেলা থেকেই সাব্বিরের বাড়িতে আমার যাতায়াত। আমি তো যেতামই, মাঝে মধ্যে আবার বাবা-মা’ও যেত। সাব্বিরের বাবা-মা, মানে আমি যাদের কাকু-কাকিমা বলে ডাকি; তারাও আসতেন আমাদের বাড়িতে। 

অনেক সময় রাতের বেলায় তাদের বাড়িতে থেকে যেতাম। কখনো সাব্বির থেকে যেত আমাদের বাড়িতে। শুধু যে গল্প বা আড্ডা দেওয়া, তা নয়— পড়াশোনা জন্যও অনেক সময়ে আমরা একসঙ্গে থাকতাম।

এমনই একটি দিনের কথা। তার আগের সন্ধ্যায় সাব্বির আমাদের বাড়িতে এলো। আমরা একসঙ্গে পড়াশোনা করলাম। ওর চলে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু কিছুক্ষণ পরে আমরা ঠিক করলাম, একটু ভিডিও গেম খেলব। তাই সব কিছু জোগাড় করে বসা হল। বেশ কিছুক্ষণ খেলতে খেলতে এমন বুঁদ হয়ে গেলাম, কখন যে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কেটে গিয়ে বুঝতেই পারলাম না। 

ঘোর কাটল, একটা ফোনে। সাব্বিরকে কাকিমা ফোন করেছেন। তখন বোধহয় বাজে রাত ১০টা মতো। উনি কি জিজ্ঞাসা করলেন জানি না,  সাব্বির আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আমি কি আজ রাতে এখানে থেকে যাব?’ আমি বললাম, ‘কেন নয়!’

আমি তখনই ছুটলাম, সাব্বিরের রাতে থাকার কথা জানাতে। ফলে খাবার বানাতে হবে। ফোনে  সাব্বির এবং কাকিমার কথার পরের অংশটা আমার আর জানা হয়নি। যাই হোক, সেই রাতে সাব্বির আমাদের বাড়িতেই থেকে গেল। পরেরদিন বোধহয় আমাদের স্কুল ছুটি ছিল। কারণ যত দূর মনে পড়ে, আমাদের স্কুলে যাওয়ার কোনো ব্যাপার ছিল না। খুব সম্ভবত সেটি ছিল রোববার।

সকালে ঘুম থেকে ওঠার পরে খেয়াল হল আমার একটা বই সাব্বিরের বাড়িতে রয়ে গিয়েছে। এবং সেদিনই সেই বইটা দরকার। আমি ওকে বললাম সে কথা। ও তখনও বিছানায় গড়াচ্ছে। আমায় বলল, ওর বাড়ি থেকে আমি যেন বইটা নিয়ে আসি। আমাদের দুই বাড়ির মধ্যে হাঁটা পথে ৭-৮ মিনিটের দূরত্ব। আমি বারবার বললাম, যেতে ইচ্ছা করছে না। কিন্তু সাব্বির বলল, সে আরো কিছুক্ষণ ঘুমোবে। আমিই যেন বইটি নিয়ে আসি। 

সাব্বিরের কাছে ওর বাড়ির একটা চাবি থাকত। আমি ওর ব্যাগ থেকে সেই চাবি বের করে নিয়ে ওদের বাড়ির দিকে রওনা দিলাম। রোববার শীতের সকাল। রাস্তাঘাটে লোকজন কম।  সাব্বিরদের দোতলা বাড়ি। আমি বাইরের দরজার চাবি খুলে ঢুকে পড়লাম। এই কাজ মাঝে মধ্যেই করতে হতো। কারণ দোতলার বারান্দা থেকে অনেক সময়েই ও চাবি ছুঁড়ে দিত। ফলে দরজা কীভাবে খোলে, তা আমি ভালোই জানতাম।

এক তলায় কাকু-কাকিমা থাকতেন। দোতলায়  সাব্বিরের ঘরে আমি সোজা সিঁড়ি দিয়ে উঠে গেলাম। সাব্বিরের পড়ার ঘরের দরজা ভেজানো। আমি ঢুকে সেই বইটা খুঁজছিলাম। হঠাৎই পাশের ঘর, মানে যেটা  সাব্বিরের শোওয়ার ঘর, সেখান থেকে গোঙানির আওয়াজ এল। বইটা ততক্ষণে পেয়ে গিয়েছি। আওয়াজটা পেয়ে মনে হল, কেউ বুঝি ব্যথা পেয়েছে, তাই গোঙাচ্ছে। 

তাড়াতাড়ি  সাব্বিরের পড়ার ঘর থেকে বেরিয়ে পাশের ঘরের দরজা খুলতে গেলাম। দরজায় ছিটকিনি ছিল না। খুলতেই, যা দেখলাম, তাতে আমি ঘাবড়ে গেলাম। দেখলাম, কাকিমা। সঙ্গে একজন লোক। বোধহয় কাকু। তখন না বুঝলেও, এখন স্পষ্ট বুঝি, তারা শারীরিক সম্পর্কে লিপ্ত হচ্ছিলেন। আমি যে দরজা খুলে তাকিয়েছি, সেটা দুজনের কেউই টের পাননি। আমিও আস্তে আস্তে আবার দরজা আগের মতো বন্ধ করে দিয়ে কেটে পড়লাম। বিষয়টি নিয়ে বেশ লজ্জা লাগল। কাকু এবং কাকিমাকে ওই অবস্থায় দেখা মোটেই উচিত হয়নি। 

এর পরে  সাব্বিরদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলাম বই হাতে নিয়ে। বেরোনোর সময়ে দরজা আগের মতো বন্ধ করে দিলাম। তালাও দিয়ে দিলাম। শুধু একটা কথা পরিষ্কার হল না, সাব্বির না থাকায়, তারা কেন ওর ঘরে শুয়েছিলেন। 

যাই হোক, এসব সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে বাড়ি ফিরছি। হঠাৎ কানে এল একটা পরিচিত গলার স্বর। ‘কী রে কোথায় গিয়েছিলি?’ খানিক হতচকিত হয়ে গেলাম। কারণ তাকিয়ে দেখি, কাকু। মানে,  সাব্বিরের বাবা। আমি যে সেই সকালে কত দূর হতবাক হয়েছিলাম, তা বলে বোঝাতে পারব না। ঘাবড়ে গিয়ে বলেছিলাম, সাব্বিরের একটা বই আনতে গিয়েছিলাম। তাতে দেখলাম, উনি খানিক বিরক্ত হলেন। কিন্তু কিছু বললেন না।

তারপর থেকে সবই আগের মতোই স্বাভাবিক থাকলেও, কোথাও যেন একটা খচখচানি রয়ে গেল।  সাব্বির এখনও একই রকম আছে। ওর সঙ্গে সম্পর্ক আরও গভীর হয়েছে। কিন্তু কাকু-কাকিমা যেন সেদিনের পর থেকে আমায় একটু এড়িয়ে চলেন। মনের মধ্যে খচখচানিটা রয়েই গেছে? কাকু কি সবই জানতেন? এমনও কি হয়? আমার কি কখনও সাব্বিরকে পুরোটা বলা উচিত? জানি না। তাই পরামর্শ চাইতে এই চিঠি।

বিশেষজ্ঞের জবাব

সম্পর্কবিদ মৌমিতা গুপ্ত এই বিষয়ে পরামর্শ দিয়েছেন। তার বক্তব্য-

আপনি এক ধরনের পারিবারিক জীবনে বড় হয়েছেন। সেটিই হয়তো আমাদের সমাজের বেশিরভাগ পরিবারের কাঠামো। সেভাবেই হয়তো বেশিরভাগ পরিবার চলে। খুব প্রচলিত কথায় যাকে বলা হয় ‘সুস্থ পারিবারিক সম্পর্ক’। কিন্তু এর বাইরে এমন বহু পরিবার আছে, যেগুলো আপনার চেনা কাঠামোর বাইরে গড়ে ওঠে। সে সব পরিবার সমাজের বেশিরভাগ পরিবারের মতো নয় বলেই, সেগুলোকে ‘অসুস্থ’ বা ‘অস্বাভাবিক’ পারিবারিক সম্পর্ক বলে দেগে দেওয়ার প্রবণতা অনেকের মধ্যেই আছে।

আপনার থেকে এই ঘটনার বিবরণ যতটা শুনলাম, তাতে আপনার বন্ধুর পরিবারটিও কিছুটা প্রচলিত কাঠামোর বাইরে বলেই আমার মনে হয়েছে। হতে পারে, আপনার বন্ধুর মায়ের কোনো এক জন প্রেমিক আছেন। হয়তো সেই সম্পর্কের কথা আপনার বন্ধুর বাবা জানেন। হয়তো সেই সম্পর্কের কথা তারা বাইরে জানাতে চান না। কিন্তু নিজেদের মধ্যে তারা ভালোই আছেন।

এমনটাও অস্বাভাবিক নয় যে, আপনার বন্ধুও হয়তো সেই কথা জানেন। তিনিও বিষয়টির সঙ্গে নিজের মতো করে মানিয়ে নিয়েছেন। বহু কিছুই হতে পারে। আবার নাও হতে পারে। কিন্তু প্রশ্ন হল আপনি কী করবেন? আপনি কি এই ঘটনার কথা মনের মধ্যে চেপে রাখবেন? নাকি এত বছর আগের ঘটনাটি আপনার বন্ধুকে জানাবেন?

আচ্ছা, আপনার কখনো মনে হয়নি, সেই সকালে আপনার বন্ধু হয়তো ইচ্ছা করেই আপনাকে ওই বাড়িতে পাঠিয়েছিলেন, যাতে আপনি নিজেও ঘটনাটা জানতে পারেন। এমনও তো হতেই পারে! তবে কি না, আপনার কথা থেকে মনে হয়েছে, আপনার বন্ধু পরে আর ওই দিনের কথা বা বাড়িতে আপনি যাওয়ার পরে কী হল, সে প্রসঙ্গ তোলেননি। ফলে এমনও হতে পারে, উনি কিছুই জানতেন না বা জানেন না।

ফলে পড়ে থাকে ওই একটি প্রশ্নই, আপনি আপনার বন্ধুকে জানাবেন কি না? কিছু কথা এমন থাকে, যা আমাদের নিজেদের পেটের মধ্যে নিয়েই জীবন শেষ করতে হয়। ধরে নিন না, এটিও তেমনই কিছু। আপনার খচখচানির কারণটি বেশ বোঝা যায়। কিন্তু একথাও তো মনে রাখা দরকার, যদি আপনার বন্ধু এদিনেও এ বিষয়ে কিছুমাত্র সন্দেহ না করে থাকেন, তাহলে তাকে আর নতুন করে অস্বস্তিতে ফেলার কারণ কী? আর যদি জেনে গিয়ে থাকেন, তাহলে আর নতুন কোন কথা আপনি তাকে বলবেন?

তাই যেভাবে এতগুলো বছর কাটিয়ে ফেলেছেন, সেভাবেই আরো কয়েকটা বছর কাটিয়ে দিন। এই কথা গোপনেই থেকে যাক না হয়!

Provaati
    দৈনিক প্রভাতী