সোমবার   ২৫ নভেম্বর ২০২৪ |  অগ্রাহায়ণ ১০ ১৪৩১ |   ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

দিঘিতে নেমেছিলেন নববধূ, পা ধরে কেউ তাকে চিরতরে টেনে নেয়

প্রকাশিত: ২৫ এপ্রিল ২০২২ ১৭ ০৫ ০২  

দিঘিতে-নেমেছিলেন-নববধূ-পা-ধরে কেউ-তাকে-চিরতরে টেনে-নেয়

দিঘিতে-নেমেছিলেন-নববধূ-পা-ধরে কেউ-তাকে-চিরতরে টেনে-নেয়

জীর্ণশীর্ণ ভগ্নদেহে ভবনগুলো দেখলে মনে কৌতূহল সৃষ্টি হবে। জানতে ইচ্ছে হবে এর পেছনের রহস্য। তবে, ইতিহাসবেত্তা কেউ হলে আপনি হারিয়ে যাবেন সেই ব্রিটিশ আমলে৷ যে সময় বাংলায় জমিদারির প্রচলন ছিল। নিজেদের কাজের সুবাদে বাংলার বিভিন্ন স্থানে তারা তৈরি করেছেন জমিদার বাড়ি। যেগুলোর এক একটি দাঁড়িয়ে আছে প্রাচীন রাজাদের স্মৃতি বহন করে৷ 

আজ আমরা আপনাদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেব লক্ষ্মীপুর জেলার ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সঙ্গে মিশে থাকা দুইটি প্রাচীন নিদর্শনের সঙ্গে। প্রথমটি দালাল বাজার জমিদার বাড়ি ও দ্বিতীয়টি খোয়া সাগর দিঘি।

দালাল বাজার জমিদার বাড়ি

লক্ষ্মীপুর শহর হতে চাঁদপুর সড়কে বাস বা সিএনজি রিকশায় ১০মিনিটের পথ উপশহর দালাল বাজার। বাজারের গলিপথ ধরে দক্ষিণে দুই মিনিট হাঁটলেই পশ্চিম পাশে চোখ ফেরালে দেখা মিলবে, দালাল বাজার জমিদার বাড়িটি। জেলা সৃষ্টি ও নামকরণের সঙ্গে এই স্থাপনাটি সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব বহন করে। 

দালাল বাজার জমিদার বাড়িটি দাঁড়িয়ে আছে ৩৬একর জমির ওপর। দালানগুলোর দৃশ্যপটে শুরুতেই চোখ আটকে যাবে যে কারো। রাজকীয় হালের প্রবেশ পথ, প্রাচীন যুগের ইটে মোড়ানো স্থাপত্য, কারিগরদের অভাবনীয় নির্মাণশৈলী। সবই আপনাকে মুগ্ধ করবে। এসবে মুগ্ধ হলেও আনন্দের কিছু নেই। এখানেই অসহ্য নিপীড়ন আর অত্যাচার চালানো হতো বাঙালিদের। 

দালাল বাজার জমিদার বাড়ি।

তবে ভবনগুলোর কারুকাজ, সৃষ্টিশীলতা দেখে অবাক হতেই হয়। ব্রিটিশ শাসনের এত বছর পরেও ইট, রডসহ অন্যান্য সরঞ্জাম যেন এখনো শক্ত। বাড়িটি ১৪ একর জমির ওপর নজরকাড়া দৃশ্যগুলো মধ্যে সম্মুখের রাজ গেইট, রাজ প্রাসাদ, জমিদার প্রাসাদ, অন্দরমহল, বাড়ির প্রাচীর, শান বাঁধানো ঘাট, নাট মন্দির, পূজা মণ্ডপ, বিরাট লোহার সিন্দুক, কয়েক টন ওজনের লোহার ভীম উল্লেখযোগ্য। 

জমিদার বাড়িটির মূলত মালিক ছিলেন রাজা লক্ষ্মী নারায়ণ। যাদের বংশের নামেই লক্ষ্মীপুর জেলার নামকরণ। প্রায় ৪০০ বছর আগে লক্ষ্মী নারায়ণ বৈঞ্চব কলকাতা থেকে কাপড়ের ব্যবসা করতে এখানে আসেন। তার পূর্ব পুরুষরা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বাণিজ্যিক এজেন্সি এবং পরে জমিদারি লাভ করেন। বাণিজ্যিক এজেন্ট হওয়ায় স্থানীয়রা তাদের নাম দেন ‘দালাল’, সেখান থেকেই নাম হয় দালাল বাজার ও দালাল বাজার জমিদার বাড়ি। 

১৯৪৬ সালের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় জমিদারগণ পালিয়ে যায়। রয়ে যায় পরিত্যক্ত জমিদার বাড়িটি৷ ২০১৫সালের ২৫জুন লক্ষ্মীপুর জেলা প্রশাসক বাড়িটির অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদ করে সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে। 

দালাল বাজার জমিদার বাড়ি।

কৌতূহলের জায়গা থেকে প্রতিদিনই পর্যটকদের মুখরে কোলাহলপূর্ণ থাকে জমিদার বাড়িটি। গেল বছর পর্যটন মন্ত্রণালয় থেকে বাড়িটিকে পর্যটন কেন্দ্র ঘোষণা করে এর ব্যাপক উন্নয়ন হয়। পর্যটকের সুবিধার জন্য নির্মান হয় পাকা সড়ক, রয়েছে বিশ্রাম নেয়ার স্থানও। সার্বক্ষণিক তদারকির জন্য রয়েছে একটি পুলিশ ফাঁড়ি। 

খোয়া সাগর দিঘি 

জমিদার বাড়ির সঙ্গে দিঘি না থাকাটা ভাবাই যায় না৷ প্রাচীন জমিদারগণ উচ্চভূমি তৈরিতে এবং বাড়ি, রাজ প্রাসাদ নির্মাণে খনন করেছেন বিশাল আয়তনের দিঘি। লক্ষ্মীপুর জেলাবাসীর নিকট খোয়া সাগর দিঘি তেমনি ইতিহাস, ঐহিত্যের ধারক ও বাহক।

২২ একর জমিজুড়ে দীঘিটির সৌন্দর্য মুগ্ধকর। চারপাশে হাঁটার পথ। শীতকালে দীঘির এক পাড় থেকে অন্য পাড়ে কুয়াশার জন্য কিছুই দেখা যায় না। কুয়াশাকে আঞ্চলিক ভাষায় খোয়া বলা হয়। দীঘিটি দেখতে সাগরের মতো। তাই এর নাম ‘খোয়া সাগর দিঘি’। লক্ষ্মীপুর শহরের অদূরে দালাল বাজারের কাছেই এটি অবস্থিত।

প্রতিদিন বিকেলে ভ্রমণ প্রেমীদের ভিড়ে মুখর থাকে খোয়া সাগর দীঘির পাড়। খোলা আকাশের নিচে মুক্ত প্রকৃতির সান্নিধ্যে থাকতে জেলা শহর থেকে বিভিন্ন বয়সীরা এখানে আসেন। দীঘির জল ছুঁয়ে আসা কোমল হাওয়া তাদের মন ছুঁয়ে যায়। ভ্রমণপিপাসুদের ছায়া হিসেবে কাজ করে বেশকিছু কড়ই গাছ। এখানে গল্পে গল্পে দারুণ সময় কাটান তরুণ-তরুণীরা। অনেকে মোবাইল ফোনে সেলফি তুলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করেন।

খোয়া সাগর দিঘি।

খোয়া সাগর দিঘিকে ঘিরে ইতোমধ্যে পর্যটন মন্ত্রণালয় বিশেষ কিছু উদ্যোগ নিয়েছে। একই সঙ্গে দিঘিকে ঘিরে পর্যটনের উন্নয়নে কাজ করছে জেলা প্রশাসন। দিঘির পাড়ে গেলে কিছু পরিবর্তন চোখে পড়ে। পর্যটকদের চলাচলের জন্য ইট দিয়ে রাস্তা নির্মাণের পাশাপাশি তাদের বসার ব্যবস্থা করা হয়েছে। রাতে এখানে রাস্তা বাতির আলোয় গল্প জমে। দিঘির সিঁড়িতে পা রেখে স্বচ্ছ জলে হাত-মুখ ধুয়ে নেন কেউ কেউ। কেউবা গোসল সারেন। 

জেলার ইতিহাস থেকে জানা যায়, ২০০ বছর আগে দিঘিটি খনন করা হয়। মূলত চারপাশের এলাকার মাটি ভরাট ও মানুষের ব্যবহার্য পানি সংরক্ষণের প্রয়োজনে এই উদ্যোগ নেন তৎকালীন রাজা জমিদার ব্রজবল্লভ রায়।

খোয়া সাগর দিঘির সঙ্গে মিশে আছে এক রূপকথার গল্প। একবার তার নববধূকে নিয়ে দিঘির পাড় দিয়ে যাচ্ছিলেন। তখন বরের পানির পিপাসা হলে যাত্রাবিরতি টেনে দিঘিতে নেমে পানি পান করেন। নববধূও পানি পানের জন্য নেমেছিলেন। কিন্তু নববধূ অঞ্জলি ভরে পানি পান করতে গেলে তার দুই পা ধরে কে যেন নিচের দিকে টেনে নিয়ে যায়। ওই বধূ আর ফিরে আসেননি। সেই স্থানে গভীর গর্ত হয়ে আছে। শুষ্ক মৌসুমে প্রচণ্ড খরায় দিঘিটি শুকিয়ে গেলেও ওই জায়গাটি কোনোভাবেই শুকায় না!

Provaati
    দৈনিক প্রভাতী
    এই বিভাগের আরো খবর