‘কুত্তার খানা’ বিদেশে পাঠিয়ে ৩০০ কোটি টাকা আয়
প্রকাশিত : ০৫:৪৫ পিএম, ২৫ অক্টোবর ২০২০ রোববার
কুত্তার-খানা-বিদেশে-পাঠিয়ে-৩০০-কোটি-টাকা-আয়
২০০৩ সালের আগে কেউই সেভাবে জানতেন না, এমন ফেলনা জিনিসও বিদেশে রফতানি হয়। তাই নাড়িভুঁড়ি রফতানিতে মোহাম্মদ ইলিয়াছকে পথিকৃৎ বলাই যায়। বর্তমানে ওই ফেলনা জিনিসই বিদেশে রফতানি করে দেশের ৪০ জন ব্যবসায়ী বছরে আয় করছেন প্রায় ৩০০ কোটি টাকা।
চট্টগ্রামের ইলিয়াছের শুরুটা যেভাবে
২০০০ সালের কথা। নানা নাটকীয়তার মাধ্যমে এ গল্পের শুরু হয়। কসাই খানা থেকে গরু জবাইয়ের পর বস্তায় ভরে নাড়িভুঁড়ি নিয়ে যাচ্ছিলো তিন যুবক। এর মধ্যে একজন পাহাড়ি ও দু’জন ছিলেন বাঙালি। ‘নাড়িভুঁড়ি দিয়ে তারা কী করবেন?’ এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে তাদের পিছু নেন ইলিয়াছ। শেষমেষ চট্টগ্রামের কালুরঘাট পর্যন্ত যেতে হয় তাকে।
ইলিয়াছ জানান, কালুরঘাটে তিনি সেই সময় দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করছিলেন। পিছু নিয়েছেন জানলে ক্ষতি করতে পারে তারা, তখন এ ভয়ও মনে ছিল। তারপর দেখলেন টিনের একটি ঘরে লবণ দিয়ে নাড়িভুঁড়িগুলো মজুত করা হচ্ছে। এক-দু’দিন নয়, এভাবে বেশ কয়েকদিন অপেক্ষা করেন ইলিয়াছ।
বিষয়টি মাথায় চেপে বসলে ইলিয়াছ তা নিয়ে খোঁজখবর নেয়া শুরু করেন। পরে জানতে পারেন, টেকনাফ স্থলবন্দর দিয়ে মিয়ানমার ও থাইল্যান্ড হয়ে নাড়িভুঁড়িগুলো চোরাই পথে ঢোকে চীনে। সেই দেশে এগুলোর ব্যাপক চাহিদা। অনেকেই চোরাইপথে এভাবেই আয় করছেন কাড়ি কাড়ি টাকা। তখন ইলিয়াছ ভাবলেন এই ব্যবসার বৈধ পন্থার কথা।
এক ফোনেই গল্পটা পাল্টে গেল
২০০৩ সালের একদিন হঠাৎ ঢাকার অভিজাত হোটেলের শেফ হিসেবে কাজ করা দুই বন্ধুর ফোন পান। তারা জানান, ভারতের মেঘালয় থেকে গরুর নাড়িভুঁড়ি কিনতে বাংলাদেশে এসেছেন ডি কংলা নামের এক নারী। চট্টগ্রামের ইলিয়াছ এই ডি কংলার কাছে সেই প্রথম বিক্রি করেন এক টন নাড়িভুঁড়ি। এরপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি ইলিয়াছকে।
ইলিয়াছ বলেন, ডি কংলাই আমাকে পুরো প্রক্রিয়া শিখিয়ে দেন। গরুর নাড়িভুঁড়ি থেকে গোবর বের করা, কাটার পদ্ধতি, ধুয়ে লবণ মাখা, এমনকি কোল্ড স্টোরেজে রাখা থেকে প্যাকিং করার কৌশল—সবই শিখিয়ে দেন ওই নারী। তার কাছেই আমি নাড়িভুঁড়ি প্রথম বিক্রি করি। এক টন নাড়িভুঁড়ি বিক্রি করে সেসময় পেয়েছিলাম ১ হাজার ডলার।
এরপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি ইলিয়াছকে। ২০০৫ সালে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন কেমরিজ সি ফুডস ইন্টারন্যাশনাল। থাইল্যান্ড, মিয়ানমার, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া ও চীনসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রফতানির পরিমাণ যেমন বাড়ছে, তেমনি বৃদ্ধি পাচ্ছে দেশের সংখ্যাও। এমনকি সাফল্যের ধারাবাহিকতায় তার হাত ধরে প্রতিষ্ঠিত হয় আরো এক কোম্পানি— জিমকো ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল।
‘কুত্তার খানা’ বেশি যায় চট্টগ্রাম থেকেই
গবাদিপশুর নাড়িভুঁড়ি ও লিঙ্গকে চট্টগ্রামের মানুষ ‘কুত্তার খানা’ হিসেবেই চেনে। তবে বর্তমানে এসব পণ্য রফতানিকারকদের বেশিরভাগই চট্টগ্রাম অঞ্চলের। এর মধ্যে রয়েছে ম্যাক্স ট্রেড, কারমেন ইন্টারন্যাশনাল, স্কাই নেট সি ফুডস কোম্পানি, কনফারেন্স ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল, ক্যামরিজ সি ফুড ইন্টারন্যাশনাল, আরএসএম ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল, স্ট্যান্ডার্ড অ্যালাইড ফুড ইন্টারন্যাশনাল, জিআর এক্সপো ইন্টারন্যাশনাল, ভিভিড এগ্রো ইন্ডাস্ট্রিজ, সানগ্রেন ট্রেডিং, আরএসবি ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল, ওশান সি ফুডস ইন্টারন্যাশনাল, ফোরজি প্রাইভেট লিমিটেড, রিফাত ট্রেডিং এজেন্সি, জোরাক ট্রেড সোর্স লিমিটেডসহ আরো বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান।
কারমেন ইন্টারন্যাশনালের মালিক আরাফাত হোসেন বলেন, ২০১৭-১৮ সালে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে ১২০ কন্টেইনার বা সাড়ে তিন হাজার টন নাড়িভুঁড়ি ও লিঙ্গ রফতানি করা হয়, যা এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ। নাড়িভুঁড়ির টন ৫-৬ লাখ টাকা, লিঙ্গ ৬-৭ লাখ টাকা। তবে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে এ পরিমাণ কিছুটা কমে যায়। অন্যদিকে করোনাকালেও স্বাভাবিকভাবে রফতানি কমেছে, তবে চাহিদা কমছে না।
৩২ হাজার কোটি টাকার বাজার
দেশের সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতা কিংবা প্রচার না থাকায় গবাদি পশুর হাড়গোড়, ক্ষুর, শিং, লেজ কিংবা রক্তের মতো শত কোটি টাকার সম্পদ ব্যবস্থাপনা ও সচেতনতার অভাবে স্থান পায় ডাস্টবিনে। অথচ সারা বিশ্বে গরু-ছাগলের নাড়িভুঁড়ি ও লিঙ্গের বাজার প্রায় ৩২ হাজার কোটি টাকার। তবে চট্টগ্রামের বেশিরভাগ এলাকাতেই এখন এসব উচ্ছিষ্টাংশ বিক্রি হয়।
চট্টগ্রাম মাংস ব্যবসায়ী সমিতি জানায়, গরু-মহিষের প্রতিটা অণ্ডকোষ ৫০ থেকে ৬০ টাকা দরে ক্রয় করা হয়ে থাকে। প্রক্রিয়াজাত করার পর একশ’ থেকে ১৫০ টাকা দরে বিক্রি করা হবে এ বর্জ্যটি। সমিতি বলছে, এ বছর কোরবানি হওয়া গরু, মহিষ, ছাগল, ভেড়া, উট ও দুম্বা থেকে দুই হাজার মণ হাড়সহ অন্য বর্জ্য সংগ্রহ করা সম্ভব হয়।
এসব পণ্য যাচ্ছে কোথায়?
গরু-ছাগলের নাড়িভুঁড়ির বেশির ভাগ রফতানি হচ্ছে চীন, হংকং, থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনামে। এসব দেশে গরু মহিষের লিঙ্গ অত্যন্ত দামি ওষুধ হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এসব দেশে পশুর একেকটি যৌনাঙ্গ ৭ থেকে ৯ ডলারেও বিক্রি হয়। এর বাইরে গরু-মহিষের দাঁত ও হাড় থেকে তৈরি হয় ক্যাপসুলের কাভার। এ ছাড়া ট্যানারি থেকে পাওয়া উচ্ছিষ্ট চামড়া দিয়ে তৈরি জুতার সোল ও প্রক্রিয়াজাত করা চামড়ার ফেলে দেয়া অংশ থেকে সিরিশ কাগজ তৈরি হয়।
অন্যদিকে পশুর রক্ত সংগ্রহের পর তা সেদ্ধ করা হয় এবং শুকিয়ে গুঁড়ো করা হয়। পরে সেই গুঁড়োর সঙ্গে শুঁটকি মাছ, সয়াবিন তেল ও যব মিলিয়ে তৈরি দানাদার মিশ্রণ ব্যবহার করা হয় পশু-পাখির খাবারের জন্য। পশুর চর্বি দিয়ে তৈরি হয় সাবান। আর শিং থেকে তৈরি হয় বোতাম ও চিরুনি। আবার মহিষের শিংয়ের ডগা ব্যবহার করে জাপানে এক ধরনের খেলনা তৈরি করা হয়। গরু ও মহিষের নাড়ি প্রক্রিয়া করে মানুষের খাবারও তৈরি করা হয়। জাপানের জনপ্রিয় ও দামি ‘শোস্যাট রোল’ নামের খাবারটিও গরু ও মহিষের নাড়িভুঁড়ি দিয়েই তৈরি।
হাজার কোটি টাকা আয়ের হাতছানি
বাংলাদেশে প্রতিদিন যে পরিমাণ গবাদি পশু জবাই করা হয়, সেসবের নাড়িভুঁড়ি ও লিঙ্গের সামান্যই সংগ্রহ করতে পারেন রফতানিকারকরা। বেশিরভাগই পরিত্যক্ত হিসেবে নদী-খাল কিংবা মাটির নিচে পুঁতে ফেলা হয়। কোরবানির ঈদে জবাই করা পশুর নাড়িভুঁড়ি ও লিঙ্গের মাত্র ১০ ভাগ সংগ্রহ করা সম্ভব হয় বিদেশে রফতানির জন্য। এই খাতের ব্যবসায়ীরা বলছেন, নাড়িভুঁড়ি ও লিঙ্গের শতভাগ যদি রফতানি করা সম্ভব হয়, তাহলে কয়েক হাজার কোটি টাকা শুধু এ থেকেই আয় করা সম্ভব।