রোববার   ২৪ নভেম্বর ২০২৪   অগ্রাহায়ণ ১০ ১৪৩১   ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

‘শ্রেষ্ঠ ভিক্ষা’

প্রকাশিত : ১২:৫৫ পিএম, ৩১ জুলাই ২০২০ শুক্রবার

শ্রেষ্ঠ-ভিক্ষা

শ্রেষ্ঠ-ভিক্ষা

“প্রভু বুদ্ধ লাগি আমি ভিক্ষা মাগি,
ওগো পুরবাসী, কে রয়েছে জাগি...” – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর 

ভিক্ষু ‘অনাথপিণ্ডদ’ নামে গৌতমবুদ্ধের একজন প্রধান শিষ্য ছিলেন। একবার বুদ্ধের নির্দেশে তিনি ভিক্ষা চাইতে শ্রাবস্তীর রাজপথে বের হলেন। সবাইকে আহ্বান করলেন নিজেদের সর্বশ্রেষ্ঠ বস্তুটি বুদ্ধের উদ্দেশ্যে দান করতে। তার আহ্বানে ধনী, বণিক, রাজা, প্রজা নির্বিশেষে সবাই অকাতরে নিজেদের মনিকাঞ্চন, কন্ঠহার ইত্যাদি নিয়ে এল। কিন্তু অনাথপিণ্ডদ কারো কাছ থেকে কিছুই গ্রহণ করলেন না। গ্রহণ করলেন মাটিতে শুয়ে থাকা এক দরিদ্র দীনহীন নারীর দান। বনের আড়ালে গিয়ে এই নারী নিজেকে লুকিয়ে হাত বাড়িয়ে নিজের পরনের কাপড় খুলে অনাথপিন্ডদকে দিল। অনাথপিন্ডদ এই দানকেই গ্রহণ করলেন শ্রেষ্ঠ ভিক্ষা হিসেবে।

আরেকটু প্রসঙ্গান্তরে যাই। বোধি লাভের পূর্বে গৃহত্যাগী গৌতম গৃধ্রকূট পাহাড়ে সঙ্গীদের সঙ্গে কঠোর তপস্যা শুরু করেন। তপস্যার প্রাথমিক পর্যায়ে তিনি ঘাস, শ্যাওলা ইত্যাদি খেয়ে ক্ষুধা নিবারণ করতেন। কাঁটার শয্যায় ঘুমাতেন। গাছের বল্কল পরে লজ্জা নিবারণ করতেন। ক্ষুধা-তৃষ্ণায় তার শরীর হয়ে গিয়েছিলো কৃশ। মেরুদণ্ড রূপ ধারণ করেছিলো সুতোর গুটির। তাঁর পেটের চামড়ায় হাত দিলে তা মেরুদণ্ডে গিয়ে ঠেকতো। এই সময়ে তার সহসা মনে হল, এই তপস্যায় নিজের মোক্ষ হলেও হতে পারে, কিন্তু দুনিয়ার দুঃখকে এভাবে বিনাশ করা সম্ভব নয়। শরীর সুস্থ না থাকলে, নিজেকে মানুষের সেবায় লাগানো যাবে কী করে? তিনি বুঝতে পারলেন এভাবে বোধিলাভ অসম্ভব। সুতরাং তিনি পুনরায় খাদ্য গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিলেন। ‘নৈরঞ্জনা’ নদীর ধারে ‘সুজাতা’ নামের এক নারী তাঁকে এক বাটি পায়েস নিবেদন করলো। এই পরমান্ন আহার করে তিনি নদীতে স্নান করলেন। অতঃপর পুনরায় ধ্যানরত হলেন। বোধিবৃক্ষের নীচে। কঠোর তপস্যার পর তিনি বুদ্ধত্বপ্রাপ্ত হলেন। দুঃখ, দুঃখের কারণ, প্রতিকার প্রভৃতি সম্বন্ধে জ্ঞান লাভ করলেন। এ ঘটনাটিই বোধিলাভ নামে পরিচিত।

এবার একটু ইতিহাসের পানে তাকাই। গৌতম বুদ্ধের শিক্ষা থেরাবাদ বা Theravada নামে  ক্রমশ পুর্বদিকে বিস্তার লাভ করে এবং একাদশ শতাব্দীর শেষভাগে মায়ানমারে প্রধানতম বিশ্বাস হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায়। এরপর এটা ত্রয়োদশ ও চতুর্দশ শতাব্দীতে কম্বোডিয়া ও লাওসের দিকে ছড়িয়ে পড়ে। এই মতবাদের আদর্শ হল স্বচেষ্টায় নিজেকে সিদ্ধ পুরুষে পরিণত করা। ধ্যান (medition) ও একাগ্রতা (concentration) এখানে আলোকিত সত্ত্বা হবার প্রধান উপাদান এবং  সন্ন্যাসী জীবনে নিজেকে উৎসর্গ করাকেই সিদ্ধি অর্জনের আদর্শ পথ বলে বিবেচনা করা হয়ে থাকে। কারণ, অনুসারীদের নিকট হতে আশা করা হয় যে, তারা সকল ধরণের পাপকার্য হতে বিরত থাকবে এবং যা কিছু শুধুমাত্র মঙ্গলময় ও আত্নাকে পরিশুদ্ধ করে থাকে তাই অর্জন করার চেষ্টা করবে। ফলে  লুয়াং প্রেবাং এর মত  ছোট্ট একটি শহরে প্রায় ৮০র অধিক ছোট বড় বৌদ্ধ মন্দির আছে এবং এগুলোতে প্রায় ৩ শতাধিক বৌদ্ধ ভিক্ষু ও শিক্ষানবিশ ভিক্ষু এই সকল মন্দিরে সন্ন্যাসীর জীবন যাপন করে। এরা সাত বা ততোধিক বয়সে নিজেদের পরিবার ছেড়ে সন্ন্যাসী সমাজে চলে আসে। 

ছবি: সংগৃহীতছবি: সংগৃহীত

একজন পূর্নবয়স্ক মঙ্ককে ভিক্ষু, শিক্ষানবিশদেরকে সামানেরা (samanera) এবং সন্ন্যাসী কমিউনিটিকে ‘সংঘ’ বলা হয়ে থাকে। এরা কেউই প্রথাগত উৎপাদনের সাথে সম্পর্কিত থাকে না। দিনের বেশীরভাগ সময়েই ধ্যান করে সময় পার করে থাকে। এমনকি মজার ব্যাপার হল দুপুরের পর আহার করাও  তাদের জন্যে নিষিদ্ধ। অর্থাৎ শুধুমাত্র সকাল ও দুপুরে তারা আহার করে।

ফলে তাদের জন্যে খাবার আসে চারপাশের সমাজ থেকে। এভাবেই থেরাভেদা বৌদ্ধমতে ‘ভিক্ষা’ একটা গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান দখল করে আছে। ইংরেজীতে একে alms giving বলে। লুয়াং প্রেবাং এর Alms Giving Ceremony জগৎবিখ্যাত। নগরের অধিবাসীরা খুব সকালে ঘুম থেকে উঠার পর ভিক্ষুদের জন্যে খাবার তৈরী করে। সাধারণত স্টিকি রাইস, যা এই অঞ্চলে খুবই জনপ্রিয়। সাথে কলা বা অন্যকোন ফুলমূল। সকালের নির্জন প্রহরে তারা বিভিন্ন রাস্তার মোড়ে অপেক্ষা করতে থাকে ভিক্ষুদের আগমনের। এক সময়ে ভিক্ষুরা ও শিক্ষানবিশরা সারিবদ্ধভাবে এগিয়ে এসে তাদের নিকট হতে এলম (alms) বা ভিক্ষা গ্রহণ করে। এই সময়ে দুই পক্ষের ভেতরে কোনরূপ কথোপকথন বা আলাপচারিতা হয় না।

খুব সকালে ঘুম থেকে জাগলাম। বৃষ্টিস্নাত সকাল। মে থেকে অক্টোবর পর্যন্ত লাওসে বর্ষাকাল। যখন-তখন মুষলধারে বৃষ্টি শুরু হয়। অথচ গতরাতে ঘুমিয়ে যাবার পূর্বে আমি আকাশে ধ্রুবতারা, কালপুরুষ – সবই দেখেছি। অথচ এখন চারদিকে অস্পষ্ট কুয়াশা। একটু দূরে পাহাড়ের ভেতর দিয়ে নেমে আসা ঝর্ণার ভেতরকার স্বচ্ছ জলের প্রবাহের ধ্বনি ছাড়া আর কোন শব্দ নেই। হোটেলের সামনের রাজপথে তখনো চলাচল শুরু হয়নি। সকাল সাড়ে পাঁচটা বাজে। 

রাস্তার পাশের ফুলের গাছ থেকে থোকায় থোকায় হলুদ-সোনালী বর্ণের ফুল ঝুলে আছে। ফুটপাতের উপরে। দৃষ্টিনন্দন এই ফুলকে আমাদের দেশে ডাকি সোনালু বলে। বাংলা নাম অমলতাস বা সোনাল। ইংরেজী নাম ক্যাসিয়া, বা গোল্ডেন শাওয়ার ট্রী। দারুণ সুন্দর লাগে ফুলের ঝুলন্ত গুচ্ছগুলো। লাওসে সোনালুর ফোটা ফুলকে স্থানীয়ভাবে বলা হয় ডক খঊন (dok khoun)। এই ফুল  তাদের নতুন বছরের উৎসবের সাথে জড়িত। লাওসের মানুষ এই ফুল দিয়ে মন্দিরে অর্ঘ দেয়। এমনকি ঘরের মধ্যেও ঝুলিয়ে রাখে। তারা বিশ্বাস করে যে,  নতুন বছরে এই ফুল তাদের পরিবারের জন্য বয়ে নিয়ে আসবে শান্তি, সৌভাগ্য ও আনন্দ।

একটু দূরে তাকাতেই দেখি মেকং নদী। এর জলও থমকে আছে। সারা প্রকৃতিতে একটা নিবিড় পবিত্র ভাব। দূরে  পাহাড়ের চুড়ায় একটা মন্দিরের সোনালী চুড়া দৃশ্যমান। দূর থেকে দেখতে সোনালু ফুলের মত। 

ছবি: সংগৃহীতছবি: সংগৃহীত

মিস্টার জ্যাকসন ঠিকই বলেছিলেন। অদ্ভুত দৃশ্য অপেক্ষা করছিল আমার জন্যে। সামনেই রাস্তার বাঁক। ফুটপাতের ওপরে হাঁটুতে ভর দিয়ে বসে আছে কয়েকজন যুবকযুবতী ও বর্ষীয়ান মানুষেরা। সবার সামনে পাত্র। পাত্রের ভেতরে স্টিকি রাইস, কলা অথবা কোন ফল। অনেক দূর থেকে লম্বা লাইনে এগিয়ে আসছে বৌদ্ধ মঙ্কদের দল। দূর থেকে মরুভূমির উটের কাফেলার মত মনে হয়। প্রতিজন মঙ্ক এসে একেকজন ভিক্ষা প্রদানকারী বা প্রদানকারিনীর সামনে থামছে। দুই পক্ষই নিঃশব্দ। সল্প সময়ের জন্যে। 

প্রদানকারী বা প্রদানকারিনী হাঁটু গেড়ে অথবা মোড়ায় বসে তার পাত্রের ভেতর থেকে এক মুঠো স্টিকি রাইস তাদের পাত্রের ভেতরে তুলে দিচ্ছে। পরম মমতায়, অথবা শ্রদ্ধায়। আমি অবাক চোখে তাকিয়ে থাকি এই অনির্বচনীয় দৃশ্যপটের দিকে। কাহলিল গিব্রানের বিখ্যাত ‘প্রফেট’ কবিতার লাইন মনে পড়ে যায়ঃ
“There are those who give with joy, and that joy is their reward.”
পেছন ফিরতেই দেখি মিস্টার জ্যাকসন। হাসিমুখে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। 
বললেন, “কেমন দেখলেন?”
আমি মুগ্ধভাবে মাথা নাড়তেই বললেন, “চলেন পাহাড়ের ওপরের মন্দিরে যাই। অনেকগুলো সিঁড়ি ভেঙ্গে উপরে উঠতে হবে।”

চলবে...