অদ্ভুত এ শহরে না থেকে ফ্রিজে থাকা ভাল!
প্রকাশিত : ০২:৫৭ এএম, ১১ এপ্রিল ২০১৯ বৃহস্পতিবার
অদ্ভুত-এ-শহরে-না-থেকে-ফ্রিজে-থাকা-ভাল
এমন একটি শহর যে শহরে বসবাস করার চেয়ে বাসার ডিপ ফ্রিজে বসবাস করাটা অনেক বেশি আরামদায়ক। কারণ সাধারণত ডিপ ফ্রিজের তাপমাত্রা থাকে মাইনাস আঠারো ডিগ্রি সেলসিয়াস। আর শীতকালে এই শহরের স্বাভাবিক তাপমাত্রা থাকে মাইনাস পঁয়তাল্লিশ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এখানে আপনার চোখের পাতা জমে বরফ হয়ে যাবে নিমিষেই। এখানকার তাপমাত্রা এতোই ঠাণ্ডা যে ফুটন্ত গরম পানি শূন্যে ছুড়ে দিলে মাটিতে পরার আগেই তা জমে বরফ হয়ে যায়। সেন্ট্রল সাইবেরিয়ার এই ছোট্ট নগরের নাম অয়মিয়াকন। পৃথিবীর সবচেয়ে শীতল এই দেশটির সম্পর্কে জানবো আজকের এই আলোচনায়। রাশিয়ার উত্তর-পূর্ব কোণের সাকারি পাবলিকে অবস্থিত অয়েমিয়া কন্সকি জেলার এক পূর্ণ শহর অয়মিয়াকন। অয়মিয়াকন নদীর নামে এর নামকরণ করা হয়েছে। সাইবেরিয়ান আঞ্চলিক ভাষায় অয়মিয়াকন অর্থ আনফ্রজিন ওয়াটার বা যে পানি কখনো জমে যায় না। এই নদীর তলদেশে একটি প্রাকৃতিক উষ্ণ পানির প্রবাহ থাকায় নদীর উপরে পানি জমে বরফ হয়ে গেলেও নিচে সেই উষ্ণ পানি সবসময় তরল অবস্থায় থাকে। অতান্ত ঠাণ্ডার কারণে অয়েমিয়াকনকে বলা হয় দ্যা পোল ওফ কোল্ড। এখানে শুধু হারহিম করা ঠাণ্ডায় নয় বরং এটি অতান্ত দুর্গমও বটে। অয়মিয়াকনের সবচেয়ে নিকটবর্তী শহর থেকে এখানে পৌছাতে সময় লাগে টানা দুই দিন দুই রাত। সোভিয়েত আমলে জোসেফট স্টালিন তৎকালীন রাজনৈতিক বন্দিদেরকে শ্রমিক হিসেবে ব্যবহার করে এই রাস্তা তৈরি করেন। চরম প্রতিকূল আবহাওয়ায় এই রাস্তা তৈরি করতে গিয়ে প্রায় দশ লাখেরও বেশি লোক মারা গেছে। কাজ করতে করতে যারা মারা যেত তাদেরকে রাস্তার মধ্যেই সমাহিত করা হয়। এই জন্য এই রাস্তাকে বলা হয় রোড অফ বোন্স বা হাড় দিয়ে তৈরি রাস্তা। বরফের পর বরফের আস্তরন জমে এই রাস্তা কাঁচের মতো পিছিল হয়ে থাকে। সামান্য একটু এদিক সেদিক হলেই নিশ্চিত বিপদ। ২০১১ সালে বিবিসিতে প্রচারিত একটি টেলিভিশনের অনুষ্ঠানে এই রাস্তাকে পৃথিবীর সবচেয়ে বিপদজনক রাস্তা হিসেবে উল্লেখ করা হয়। বিগত প্রায় শত বছর ধরে অয়েমিয়াকনের বাসিন্দারা একই রকম জীবন যাপন করে আসছে। শীতকালে এখানে খাবার পানির কষ্ট সবচেয়ে বেশি। এখানে কোনো পানির সরবারহের ব্যবস্থা নেই। পাইপের ভেতর পানি প্রবাহিত হওয়ার আগেই পানি জমে বরফ হয়ে যায়। কারণ চিন্তা করুন ডিপ ফ্রিজের এর চেয়েও তিন গুণ বেশি ঠাণ্ডায় কোন পানিই তরল থাকার কথা নয়। আর এজন্যই ঘর গরম রাখার জন্য যে কাঠ পোরানো হয় সেখানেই তারা মিশিয়ে দেয় বরফের টুকরো। এই বরফ গলে যে পানি উৎপন্ন হয় তাই তারা পান করে। শুধু পানিই নয়, প্রতিদিনের খাবার যোগার করাও এখানে বেশ কষ্টের। অয়েমিয়াকনের বাসিন্দাদের প্রধান খাবার হল ঘোড়ার মাংস। আর তাই এই ঘোড়াগুলো স্থানীয় বাসিন্দাদের জন্য অত্যন্ত জরুরি। এখানকার ঘোড়াগুলোও এই চরম ভাবাপন্ন তাপমাত্রার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিয়েছে। তারা চব্বিশ ঘণ্টা খোলা পরিবেশেই থাকে। তবে একটাই ঝামেলা তা হল এসব ঘোড়ার শরীরের বাইরের অংশে বরফ জমে যায়। আর তাই ঘোড়াগুলোকে সুস্থ রাখতে অতন্ত শক্ত চিরুনি দিয়ে নিয়মিত তাদের শরীর থেকে বরফ ছাড়াতে হয়। গ্রীষ্মকালে অয়মিয়াকনের দিনের দৈর্ঘ্য থাকে প্রায় একুশ ঘণ্টা আর শীতকালে এখানে দিনের দৈর্ঘ্য হয় মাত্র তিন ঘণ্টা। এসময় তাপমাত্রা মাইনাস পঞ্চান্ন ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে নেমে গেলে স্থানীয় বাসিন্দারা খুবই অসুবিধায় পরে যায়। কারণ এই তাপমাত্রায় ফ্রস্ট ব্রাইট হওয়ার সম্ভাবনা থাকে অনেক বেশি। ফস্ট ব্রাইট হল প্রচন্ড ঠাণ্ডায় শরীরের অনাবৃত কোন স্থানের রক্ত জমাট বেঁধে যাওয়া। শরীরের কোন অংশ ফাস্ট ব্রাইট হলে আক্রান্ত কোষগুলো ধীরে ধীরে শরীর থেকে খসে পরে। তাই তাপমাত্রা মাইনাস পঞ্চান্ন ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে নেমে গেলে বাড়ির বাইরে বের হওয়াটা অনিরাপদ বলে মনে করা হয়। সে সময় এখানকার একটি মাত্র স্কুলও ছুটি দিয়ে দেয়া হয়। অয়মিয়াকনের তাপমাত্রা এতোই ঠাণ্ডা যে ফুটন্ত গরম পানি শূন্যে ছুড়ে দিলে তা মাটিতে পড়ার আগেই জমে বরফ হয়ে যায়। এখানকার শীতের তীব্রতার আর একটি উদাহারন হলো কোনো খাবার বা ফলমূল জমে এতোই শক্ত হয়ে যায় যে তা আর খাবার উপযোগী থাকে না। অয়মিয়াকনের জমে যাওয়া কলা দিয়ে আপনি অনায়াসে হাতুড়ির কাজ করতে পারবেন। অয়েমিয়াকনের শীতকালের কাপড় কাচার কথা ভাবাও যায় না। কারণ ফুটন্ত গরম পানি দিয়ে কাপড় ধুলেও তা জমে এমন শক্ত হয়ে যায় যে কাপড় আর ব্যবহার উপযোগী থাকে না। শীতকালে সকাল, দুপুর, রাত তিনবেলা শুধু ঘোড়ার মাংস খেতে খেতে অয়েমিয়াকনের বাসিন্ধাদের অভক্তি চলে আসে। তাই এখানকার জেলেরা তাদের বলগা হরিণের টানা গাড়িতে চড়ে স্থানীয় নদীতে মাছ স্বীকার করতে যায়। নদীগুলো শীতকালে পুরোপরি জমে বরফ হয়ে থাকে। তবুও মাছ খুঁজে পেতে জেলেদের একটুও বেগ পেতে হয় না। কারণ মাছের সন্ধানে স্থানীয় ইগল পাখি আগেই গর্ত করে রাখে। জেলেরা শুধু সেই সব গর্ত খুড়ে মাচ সংগ্রহ করে। সেই জন্য জেলেদের দরকার পরে অতান্ত দুইটি গর্তের এপার থেকে ওপার জাল বিছিয়ে সহজেই প্রচুর মাচ ধরা যায়। নদী থেকে ওপরে তোলার পর জেন্ত মাছ সঙ্গে সঙ্গে জমে বরফ হয়ে যায়। স্থানীয়দের মধ্যে একটি কথা প্রচলিত আছে অয়মিয়াকন তৈরির সময় সৃষ্টিকর্তার হাত ঠাণ্ডায় জমে গেয়েছিল আর তাই তার হাত ফসকে এখানে প্রচুর সম্পদ দিয়ে দেন। অয়েমিয়াকন সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে মাত্র সাতশো মিটার উচুতে অবস্থিত। কিন্তু এর এতো শীতল হওয়ার কারণ হল ভূপ্রকৃতির এক বিশেষ অবস্থা। এর আশে পাশে কোন কিছু না থাকার জন্য চরম ভাবাপন্ন শীতল তাপমাত্রা প্রশমিত হতে পারে না এবং এই বসতি এক উপওকার অতান্ত নিচের দিকে অবস্থিত। দুইটি পর্বত শ্রেণীর মধ্যবর্তী অঞ্চলে অবস্থিত হওয়ার কারণে এখানকার ঠাণ্ডা বাইরে যেতে পারে না। ১৯২০ সালে অয়েমিয়াকনের তাপমাত্রা মাইনাস বায়াতুর ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয়। যা স্থায়ী বসতিপূর্ণ এলাকায় রেকর্ড করা পৃথিবীর সর্বনিম্ন তাপমাত্রা। আর তাই একে বলা হয় পৃথিবীর সবচেয়ে শীতল শহর। অয়মিয়াকনে যারা কখনো যায়নি, তাদেরকে এখানকার শীতের তীব্রতা বোঝানো সম্ভব নয়। একেতো প্রচণ্ড ঠাণ্ডা তার ওপর আবার অত্যন্ত দুর্গম। এই দুটি কারণে অয়মিয়াকনে জীবনযাপন খুবই কষ্টের। বিগত কয়েক দশকে অয়েমিয়াকনের জনসংখ্যা কমে গেছে ব্যপকহারে। বর্তমানে ছোট্ট এই পৌর শহরে প্রায় পাঁচ'শ থেকে নয়'শ জন লোক বাস করে। এই জনসংখ্যার মধ্যে কোন লম্বা মানুষ নেই। বরং এখানে নিয়মত যারা বাস করে তারা দিন দিন আরো খাটো হয়ে যাচ্ছে। এর জন্য একাধিক শরীর বৃত্তীয় কারণ দায়ি। স্থানীয়দের শরীরের তাপমাত্রা সরাসরি বেড়িয়ে যেতে না পারা তার মধ্যে অন্যতম। এছাড়া গরমকালেও এখানে বাস করা খুব সহজ নয়। জুন ও জুলাই গ্রীষ্মকালের এই দুই মাসে সব বরফ গলে খুব বাজে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। চারদিকে শুধু জলাবদ্ধতায় প্রচুর মশা ও ক্ষতিকর কালো মাছির জন্ম নেয়। তখনও এর সর্বনিম্ন তাপমাত্রা থাকে প্রায় মাইনাস দশ ডিগ্রি সেলসিয়াস। তবে গ্রীষ্মকালে অয়েমিয়াকনের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে প্রায় চৌত্রিশ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এখন পর্যন্ত পৃথিবীতে প্রায় তিনটি স্থানে ঋতুভেদে একশো ডিগ্রি তাপমাত্রার বাবধান পাওয়া গেছে। অয়মিয়াকন তার মধ্যে অন্যতম। পৃথিবীর সর্বনিম্ন তাপমাত্রা মাইনাস ৯৪.৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয়েছে পূর্ব এন্টারটিকায়। এন্টারটিকা মহাদেশের পরিবেশ এতোই ঠাণ্ডা যে এখনো কোন মানুষের পক্ষেই স্থায়ীভাবে বসবাস করা সম্ভব নয়। সাধারণত শীতকালে এখানে তাপমাত্রা থাকেকে মাইনাস আশি থেকে মাইনাস নব্বই ডিগ্রি সেলসিয়াস। ডেইলি বাংলাদেশ/টিআরএইচ