বৃহস্পতিবার   ১৪ নভেম্বর ২০২৪   কার্তিক ৩০ ১৪৩১   ১২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

‘বাবা লোকনাথ- রক্ষা করো’

প্রকাশিত : ০৩:৫৫ পিএম, ১৬ নভেম্বর ২০১৯ শনিবার

বাবা-লোকনাথ--রক্ষা-করো

বাবা-লোকনাথ--রক্ষা-করো

হালকা কুয়াশা, ঠান্ডা বাতাস। সূর্যটাও ঢলে পড়েছে তাড়াতাড়ি! এমন আবহে গ্রামগঞ্জে কোলাহল না থাকাটাই স্বাভাবিক। কিন্তু কার্তিকের শেষ ভাগে সোনারগাঁওয়ের বারদী হয়ে ওঠে উৎসবমুখর। লোকনাথ আশ্রমে ভিড় করে হাজারো মানুষ। মাটির প্রদীপ, ঘি, কলাপাতা, ফুল, ধান-দূর্বা, ডাব, দুধসহ নানান নৈবেদ্য নিয়ে বসে থাকেন হাজারো শ্রী শ্রী লোকনাথ ব্রহ্মচারীর ভক্ত।

সন্ধ্যার আগেই বাড়ি থেকে আনা ফলমূল কিছুক্ষণের জন্য রাখা হয় লোকনাথের মূর্তির সামনে। তারপর সেগুলো নিয়ে উন্মুক্ত ময়দানে সারিবদ্ধভাবে বসে যায় সবাই। সামনে কলাপাতার ওপর রাখা হয় ঘিয়ের প্রদীপ। চারপাশে সাজানো থাকে নানা রঙের কাটা ফল। সূর্যাস্তের সঙ্গে সঙ্গে বেজে ওঠে ঘণ্টা। একসঙ্গে জ্বলে ওঠে শত শত প্রদীপ। ওপর থেকে দেখা সেই দৃশ্য দেখতে স্বপ্নের মতো। সবাই একই সুরে বলতে থাকেন- ‘বাবা লোকনাথ, বাবা লোকনাথ গো, এবার আমাদের রক্ষা করো গো’।

প্রদীপ প্রজ্জলন শেষে সারাদিনের উপবাস ভাঙা হয়। লোকনাথভক্তরা মূলত আপনজনের কল্যাণ কামনা করে এই উপবাস করেন। কলেরা-বসন্তের হাত থেকে বাঁচার জন্য কার্তিক মাসে উপবাস পালন এবং আশ্রম প্রাঙ্গণে ঘিয়ের প্রদীপ ও ধূপ-ধুনা জ্বালানোর নির্দেশ দিয়েছিলেন বাবা লোকনাথ। সেই থেকে সোনারগাঁওয়ের বারদী লোকনাথ আশ্রমে প্রতি বছর কার্তিক মাসের শেষ ১৫ দিনের প্রতি শনি ও মঙ্গলবার হয় এই উৎসব। ‘কার্তিক ব্রত’, ‘রাখের উপবাস’, ‘গোসাইর উপবাস’, কিংবা ‘ঘৃত প্রদীপ প্রজ্জ্বলন’; লোকনাথভক্তদের কাছে এই উৎসব নানা নামেই পরিচিত।

ঘৃত প্রার্থনা করছেন পুণ্যার্থীরাঘৃত প্রার্থনা করছেন পুণ্যার্থীরা

প্রদীপ জ্বালানো হলে ধূপের ধোয়ায় আচ্ছন্ন আশ্রমে এবারই প্রথম যাওয়া। সঙ্গে ছিলেন দৈনিক প্রভাতী সম্পাদক, মফস্বল বিভাগের ইন-চার্জ ও একজন ডিজিটাল মার্কেটার। সোনারগাঁও প্রতিনিধির সাহায্য নিয়ে আমরা গিয়েছিলাম বারদীতে। অনুষ্ঠান শেষ না অবধি অবস্থান করেছিলাম উৎসবের নানা পর্ব ও আনুষ্ঠানিকতা সরাসরি উপভোগ করতে। শ্রী শ্রী লোকনাথ ব্রহ্মচারী কার্তিক প্রতিষ্ঠিত শ্রী শ্রী লোকনাথ ব্রহ্মচারী আশ্রমেই হয় এই উৎসব। যা সবচেয়ে বেশি পরিচিত ‘বারদী আশ্রম’ নামে।

কী হয় এই উৎসবে

সন্ধ্যা নামার আগে সারিবদ্ধভাবে আশ্রম ঘিরে বসতে শুরু করেন পুণ্যার্থীরা৷ অপেক্ষায় থাকেন সূর্য ডোবার। সূর্য পশ্চিমাকাশে ঢলে পড়লে ঘিয়ের প্রদীপে আগুন জ্বালান ভক্তরা। অন্ধকার ভেদ করে তখন ভক্তদের পবিত্র প্রদীপালোকে আলোকিত হয় চারপাশ। প্রদীপ জ্বালানো হলে ধূপের ধোয়ায় আচ্ছন্ন আশ্রমে প্রার্থনায় মগ্ন হন পুণ্যার্থীরা। আপনজনের জন্য কল্যাণ কামনা করেন তারা।

প্রদীপ জ্বালানো নিয়ে এখানে একটি বিশেষ নিয়ম আছে। বিপদ থেকে রক্ষার জন্য যে কয়জন আপনজনের উদ্দেশ্যে প্রার্থনা করা হয়, গুনে গুনে সেই ক’টি প্রদীপই রাখা হয়। তিন-চার-দশ-বিশটা পর্যন্ত প্রদীপ দেখা যায়। তাই এখানে ভক্তের চেয়ে প্রদীপের সংখ্যা কয়েকগুণ বেশি থাকে। সারিবদ্ধভাবে জ্বালানো এই হাজার হাজার প্রদীপ হালকা হিম আবহাওয়ার সঙ্গে মিশে তৈরি করে অনিন্দ্য সুন্দর অপার্থিব আবহ।

ধোঁয়া থেকে বাঁচতে মাথায় পলিথিন মুড়িয়েছে এক কিশোরধোঁয়া থেকে বাঁচতে মাথায় পলিথিন মুড়িয়েছে এক কিশোর

পুন্যার্থী দিলীপ ঘোষ এবার আটটি প্রদীপ জ্বালিয়েছেন। দিনাজপুর থেকে এসেছেন তিনি। তার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রদীপ জ্বালানোর সময়টাকে বলা হয় ‘ঘৃত প্রদীপ প্রজ্বলন’। দিলীপ বলেন, বছরের অন্যান্য সময়ে আমরা মন্দিরে তেলের প্রদীপ জ্বালিয়ে থাকি। কিন্তু এখানকার নিয়মানুযায়ী ঘি দিয়ে জ্বালাতে হয়। এর পেছনেও কারণ আছে। বাবা লোকনাথ উপলব্ধি করেন, তেলের বদলে ঘৃত প্রার্থনার কারণে কলেরা আর বসন্তের হাত থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব।

প্রদীপ প্রজ্জলন ও প্রার্থনার মুহূর্তগুলো দেখে মনে হয় এ এক ভিন্ন জগৎ! আলো আঁধারে অদ্ভুত কিছু সময় কাটাতে এবং সেই মুহূর্তগুলো ক্যামেরা বন্দি করতে দেশ-বিদেশ থেকে বহু আলোকচিত্রী ছুটে আসেন বারদীতে। এবারও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি। চীন, যুক্তরাজ্য, জার্মানসহ বেশ কয়েকটি দেশের পর্যটক এসেছেন। চীনা নাগরিক ঝাং ইয়াং বলেন, ষাটগম্বুজ মসজিদ, সুন্দরবন ঘোরার ইচ্ছে ছিল অনেকদিনের। কিন্তু যখন শুনলাম এখানে এমন একটা উৎসব হয়, তখন মিস করতে চাইনি। তাই এই সময়টায় আসা।

ঘিয়ের প্রদীপ জ্বালানো শেষ হলে ভাঙা হয় সারাদিনের উপবাস। আশ্রমের পক্ষ থেকে কিছু প্রসাদের ব্যবস্থা করা হয়। ভক্তদের নিয়ে আসা নৈবেদ্য আর সঙ্গে আরো কিছু খাবার যোগ করে প্রস্তুত করা হয় এই প্রসাদ। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কার্তিকের এই ব্রতকে কেন্দ্র করে নানান জায়গা থেকে আসা ভক্তরা বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে খিচুড়ি বা ফল প্রসাদ হিসেবে বিতরণ করে থাকেন।

বিপদ থেকে মুক্তি পেতে জ্বালানো হয় প্রদীপবিপদ থেকে মুক্তি পেতে জ্বালানো হয় প্রদীপ

এই আয়োজনের আরেকটি অংশ নাট মন্দিরের অধিবাস কীর্তন। প্রসাদপর্ব চলার সময়ই শুরু হয় এই পর্ব, চলে একেবারে মধ্যরাত অবধি। মন্দিরের বেদির ঠিক মাঝখানে করা চারদিক খোলা মঞ্চে চলে এই অনুষ্ঠান। চারিদিক থেকে ঘিরে থাকে ভক্তরা আর কীর্তনকারী দলের কেউ একজন চারদিকের দর্শকদের একেবারে মোহিত করে ফেলে কীর্তনের মাধ্যমে। মূলত শ্রী লোকনাথ ব্রহ্মচারীর জীবনের নানা অধ্যায় আর শ্রী কৃষ্ণের নানার লোকগাথাকে কেন্দ্র করে একের পর এক পালা গানের মতো বাঁশি, করতাল, খোল ও হারমোনিয়ামের সঙ্গে সঙ্গত করে চলতে থেকে এই কীর্তন।

স্থানীয়দের বয়ানে কার্তিক ব্রত

অসাম্প্রদায়িক চেতনার মূর্ত প্রতীক বারদী আশ্রম, এমনটাই বললেন বারদী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জহিরুল হক। তিনি বলেন, যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশে লোকনাথ বাবার আশ্রম একটিই ছিল। এখন অনেক জায়গাতেই লোকনাথ আশ্রম হয়েছে। আমার এখনো মনে পড়ে ১৯৭৫ সালের কথা। তখন ঠিকমতো রাস্তাও ছিল না। খাল-কাঁচা রাস্তা পার হয়ে এখানে দেশ-বিদেশ থেকে মানুষজন আসতো। তখন থেকেই হিন্দু, মুসলিম সবাই মিলে শান্তিপূর্ণভাবে আয়োজন সম্পন্ন করার চেষ্টা থাকতো।

তিনি আরো বলেন, রাখের উপবাসের আয়োজনটা ওদের নিজস্ব ফান্ড থেকেই হয়। তবে আমি শুনেছি, এবারই প্রথম সরকার কর্তৃক একটা ফান্ড এসেছে। আর নিরাপত্তা নিয়েও কোনো চিন্তা করতে হয় না। লোকনাথ ভক্তরা এখানে স্বাধীনভাবে চলাফেরা করতে পারে। জুট-ঝামেলার কোনো আশঙ্কা নেই এখানে। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে আরো বেশি জাঁকালো হয় এই আয়োজন। একসময় মাঠে গাড়ি রাখরে চাঁদা দিতে হতো, এখন একেবারেই ফ্রি।

পুণ্যার্থীরা সারিবদ্ধভাবে বসেন এবং একই নিয়মে প্রার্থনা করেনপুণ্যার্থীরা সারিবদ্ধভাবে বসেন এবং একই নিয়মে প্রার্থনা করেন

স্থানীয় দোকানদার ফরিদ হোসেন বলেন, আমার ছোট থেকেই এই আয়োজন দেখে আসছি। কখনো কোনো বিশৃঙ্খলা দেখিনি। আশ্রমের কারণেই এখানকার দোকানপাট এতটা জমজমাট। এখানকার প্যাড়া সন্দেশ, সরিষার তেল থেকে শুরু করে অনেক কিছুই পরিচিত পেয়েছে রাখের উপবাসে মানুষের সমাগমের কারণে।

লোকনাথ বাবা ও বারদী আশ্রম

লোকনাথ ব্রহ্মচারী একজন হিন্দু ধর্মগুরু। পাহাড়-পর্বতে, বনে-জঙ্গলে বহু ক্লেশ সহ্য করে তিনি যা অর্জন করেছেন, তা লোকালয়ে এসে সাধারণ মানুষে মাঝে অকাতরে বিলিয়ে দিয়েছেন। আফগানিস্তান, মক্কা, মদিনা, পারস্য, গ্রীস, তুরস্ক, ইতালি, ফ্রান্স, সুইজারল্যান্ডসহ বহু জায়গায় গিয়েছেন জ্ঞান অর্জন করতে। তার দীক্ষাগুরু ছিলেন ভগবান গাঙ্গুলী। জ্ঞানকেই তিনি বলেছেন চোখ, জ্ঞানের চেয়ে বড় কিছু ছিল না তার কাছে। সে জ্ঞান তিনি বিলিয়ে দিয়েছেন ভক্তদের মাঝে, বিনিময়ে পেয়েছেন শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা।

লোকনাথ ব্রহ্মচারী চব্বিশ পরগনা জেলার বারাসাত মহকুমার অন্তর্গত কচুয়ায় এক ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। জন্ম তারিখ আনুমানিক ১১৩৮ বঙ্গাব্দের ১৮ ভাদ্র। তিনি পিতা রামকানাই ঘোষাল এবং মাতা কমলাদেবীর চতুর্থ সন্তান। ভগবান গঙ্গোপাধ্যায় লোকনাথ ও তার বাল্যবন্ধু বেণীমাধব বন্দ্যোপাধ্যায়ের দীক্ষাও উপনয়ন সংস্কার করে তাদেরকে নিয়ে পরিব্রাজন করতে হিমালয়ে চলে যান। তারা হিমালয় ছাড়াও ভারতের বিভিন্ন স্থানে পর্যটন ও সাধনা করতে থাকেন। লোকনাথ ও বেণীমাধবের বয়স যখন ৯০ বছর তখন গুরু ভগবান গাঙ্গুলী তাদেরকে হিতলাল মিশ্রের (মতান্তরে ত্রৈলঙ্গস্বামী) নিকট সমর্পণ করে দেহত্যাগ করেন। তারপর তারা গুরুর তত্ত্বাবধানে হিমালয় ও তিব্বতের নানা পার্বত্য স্থানে পর্যটন করেন।

এ এক ভিন্ন জগৎ, এখানে আলো আঁধারে কাটে অদ্ভুত কিছু সময়এ এক ভিন্ন জগৎ, এখানে আলো আঁধারে কাটে অদ্ভুত কিছু সময়

অত্যন্ত সহজ সরল ভাষায় প্রচার করতেন বাবা লোকনাথ। বলেছিলেন‚ ঘটা করে পুজো আচ্চার দরকার নেই। মনে ভক্তি নিয়ে তাকে ডাকলেই তিনি সাড়া দেবেন। রণে বনে জলে জঙ্গলে‚ যেখানে তার ভক্ত বিপদে পড়বে। তার পুজার প্রসাদও সামান্য‚ মিছরি ও জল। দরিদ্র নরনারায়ণ সেবার ওপরে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়ার জন্য ভক্তদের নির্দেশ দিয়েছিলেন এই সাধক। ১২৯৭ বঙ্গাব্দের ১৮ জৈষ্ঠ্য আশ্রমবাসীদের দুপুরের ভোজনের পর ধ্যানযোগে প্রয়াত হয়েছিলেন। এই সিদ্ধ পুরুষের সমাধি অবস্থিত নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ এর বারদী অঞ্চলে। যা শ্রী শ্রী লোকনাথ ব্রহ্মচারী আশ্রম নামে খ্যাত।