অজ্ঞান-মলম পার্টির ভয়ে রাত জেগে পাহারা
প্রকাশিত : ০৬:১৫ পিএম, ১২ অক্টোবর ২০২২ বুধবার
অজ্ঞান-মলম-পার্টির-ভয়ে-রাত-জেগে-পাহারা
গত তিন মাসে উপজেলার ভজনপুর এলাকায় চারটি বাড়িতে রাতের আঁধারে ঘুমের ও চেতনানাশক ওষুধ খাইয়ে টাকাসহ গহনাপত্র চুরির ঘটনা ঘটছে। ফলে এমন চুরির ঘটনার কারণে নিরাপত্তার স্বার্থে রাত জেগে বাড়ির পাহারা দিচ্ছেন স্থানীয়রা।
জানা যায়, জেলার তেঁতুলিয়া উপজেলার ভজনপুর ও দেবনগড় ইউপির বিভিন্ন এলাকায় ঘুম ও চেতনানাশক ওষুধ দিয়ে রাতের আঁধারে পরিবারের সবাইকে ঘুম পাড়িয়ে টাকা, গহনা, জমির দলিল, গুরত্বপূর্ণ কাগজপত্র ও আসবাপত্র চুরি করে নিয়ে যাচ্ছে চক্রটি৷ অনেকেই পুলিশের কাছে আটক হলেও স্থানীয় কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তি তাদের জামিনের ব্যবস্থা করার বলে অভিযোগ ভুক্তভোগীদের।
ভুক্তভোগীরা জানান, যে চক্রটি এমন ঘটনা ঘটাচ্ছেন তারা স্থানীয় মাদকাসক্ত যুবক, তাদের বিরুদ্ধে থানায় একাধিক মামলাও রয়েছে। তার মধ্যে দুই একজন পালাতকও রয়েছেন। মূলত বসতবাড়িতে চুরির জন্য স্থানীয়রা ওই মাদকাসক্ত যুবকদের বিভিন্ন এলাকা থেকে চোর ভাড়া করে নিয়ে এসে এলাকার প্রভাবশালী ও ব্যবসায়ীদের বাড়িতে সুযোগ বুঝে এমন চুরির ঘটনা ঘটাচ্ছেন।
তারা আরো জানান, চক্রটি তাদের স্থানীয় সোর্সের মাধ্যমে কোন বাড়িতে চুরি করবে সেটা নিশ্চিত হয়ে প্রথমেই গোপনে ও কৌশলে সেই বাড়িতে প্রবেশ করে। পরে রান্নাঘরের চা, চিনি, হলুদ, মরিচ গুড়া, পানি,লবণসহ বিভিন্ন মসলার সঙ্গে চেতনা নাশক মেডিসিন মিশিয়ে দিয়ে রাখে। পরে সেই উপকরণ দিয়ে রান্না করার পর পরিবারে সদস্যরা রাতের খাবার খেয়ে ঘুমিয়ে পড়লে এতে দীর্ঘ কয়েক ঘণ্টা অচেতন হয়ে থাকে পরিবারের সদস্যারা। এদিকে সেই সুযোগে রাতের আঁধারে সেই বাড়িতে প্রবেশ করে টাকা, পয়সা,দলিলপত্রসহ বিভিন্ন আসবাপত্র চুরি করে নিয়ে যায়। এভাবে উপজেলায় কয়েকটি এলাকায় চুরির ঘটনা ঘটেছে। এতে জীবনের অর্জিত সব সম্বল হারিয়ে পথে বসেছে অনেকেই।
ওই এলাকার ব্যববসায়ী, দোকানদার থেকে শুরু করে ইউনিয়ন পরিষদের গ্রাম চৌকিদারের বাড়িতেও এমন চুরির ঘটনা ঘটেছে। হঠাৎ বাড়িতে চুরি হয়ে পথে বসেছেন এমন কয়েক জন ভুক্তভোগী হলেন তেঁতুলিয়া উপজেলার ভজনপুর ইউপির গোলাপব্দীগছ এলাকার বাসিন্দা শরিফুল ইসলাম ও তার ভাই বকুল হোসেন, একই ইউপির ভদ্রেশ্বর এলাকার রবিউল ইসলাম, শান্তিনগর এলাকার গ্রাম চোকিদার সেকেন্দার, নয়াবাড়ি এলাকার ব্যবসায়ী রফুিকুল ইসলাম, দেবনগড় ইউপির আমজুয়ানী এলাকার ব্যবসায়ী ইসহাক আলী, শেখগছ এলাকার হাইয়ুল ইসলাম।
গত এক-দেড় বছরে উপজেলায় এমন চুরির ঘটনা ঘটেছে অর্ধশতাধিক বাড়িতে। এ ঘটনায় ভুক্তভোগীরা তেঁতুলিয়া মডেল থানায় অভিযোগ করলেও এতে কোন সুরাহা পায়নি তারা। ফলে ধরা ছোঁয়ার বাইরে থাকছে চক্রটির সদস্যরা।
জানা যায়, এক সময় করতোয়া নদী ও সমতল ভূমিতে প্রচুর পরিমাণে পাথর তোলা হতো। কিন্তু পাথর তোলার সময় অবৈধ ড্রেজার মেশিন দিয়ে পাথর তোলার কারণে পরিবেশ রক্ষার স্বার্থে পাথর তোলা বন্ধ রেখেছে সরকার।
অন্যদিকে বেকার হয়ে পড়ায় অনেক যুবক মাদকাসক্ত ও বিভিন্ন অসামাজিক অপকর্মে লিপ্ত হয়েছেন। তারা শুধু মাদক সেবনেই নয়, ভারত থেকে মাদক পাচার করে নিয়ে এসে পরবর্তীতে সেবনের জন্য বিক্রি, অবৈধ পথে গরু পারাপারা, রাতের আঁধারে বিভিন্ন সড়কে মানুষকে জিম্মি করে অর্থ আদায় এবং বিভিন্ন বসতবাড়ি ও ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানে চেতনানাশক ওষুধ খাইয়েসহ বিভিন্ন কৌশলে চুরি করে বেড়াচ্ছে। তাদের কোনো পেশা কিংবা আয়ের পথ না থাকলেও কিছু দিনের মধ্যে চক্রটির সদস্যরা বনে গেছেন লাখপতি। পাকা বাড়ি, ফ্ল্যাটসহ আলিসান বাড়ি, মোটরসাইকেলসহ চলাফেরা যেন তাদের রাজকীয়দের মতো। কদিন পর পর বিভিন্ন এলাকায় ধরা পড়ে জেলহাজতে গেলেও দুদিনের মাথায় জামিনে মুক্তি পয়ে পুনরায় একই কাজে লিপ্ত হচ্ছেন তারা। ফলে দিন দিন তাদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ ও আতংকে দিনরাত্রি পার করছে উপজেলার সাধারণ মানুষরা।
ভুক্তভোগীরা ভজনপুর এলাকার সাহিরুল ইসলাম, তারেক, হানিফ বাবু, জাকের, নজমুল ইসলাম, হাসনুর ও বকুলসহ বেশ কয়েকজনকে সন্দেহ করছেন। কয়েক জনের বিরুদ্ধে থানায় একাধিক মামলাও রয়েছে, তবে তারা ধরা ছোঁয়ার বাইরে রয়েছেন বলে জানান তারা।
অভিযুক্ত হানিফ বাবুর নামে একজন বলেন, এলাকার কোনো মানুষের বাড়িতে চুরি হলেই পুলিশ আমাকে ধরে মামলা দেয়। তাই আমি এই বিষয়ে মুক্তি চাই। আগে মাইক্রোবাস চালাতাম, অনেকেই আমাকে ভাড়া নিয়ে যেতো। তাই তাদের সঙ্গে আমার যোগাযোগ থাকায় বিষয়গুলো জানতাম। এখন তাদের সঙ্গে যোগাযোগ নেই। আমার নানার বাড়িতে মায়ের কিছু সম্পদ পেয়েছি সেগুলো থেকে কিছু টাকা পেয়ে ব্যবসা করে চলতেছি।
ভুক্তভোগী শরিফুল ইসলাম ও বকুল ইসলাম বলেন, গত কয়েক দিন আগে আমাদের বাড়িতে মলমপার্টি প্রবেশ করে রাতে চেতনানাশক ওষুধ খাইয়ে আমাদের আলমারির তালা ভেঙে টাকা-পসয়া সোনা-গহনা ও জমির দলিলপত্র চুরি করে নিয়ে গেছে। এ ঘটনায় তেঁতুলিয়া মডেল থানায় অভিযোগ দিলেও পুলিশ তদন্ত করে এসে চলে গেছে আর কোনো খবর নেই।
ভদ্রেশ্বর এলাকার ভুক্তভোগী বাসিন্দা রবিউল ইসলাম বলেন, আমার বাড়িতে কৌশলে খাবারে চেতনানাশক ওষুধ মিশিয়ে রাখে চক্রটি। পরে রাতে খাবার খেয়ে স্ত্রী সন্তান নিয়ে ঘুমিয়ে পড়লে আমার ঘরের আলমারী ভেঙে ১৫ লাখ টাকা নিয়ে যায় মলমপার্টি। টাকা চুরির কারণে আজ পথে বসেছি৷
দেবনগড় ইউপির বাসিন্দা ইসহাক আলী বলেন,আমার বাড়ির সবাইকে ঘুম ও চেতনানাশক ওষুধ খাইয়ে আমার টাকা পয়সা চুরি করে পালিয়েছে চক্রটি। তারা বিভিন্ন এলাকায় ধরা পড়লেও প্রশাসন তাদের কিছুই করতে পারে না৷
ভজনপুর ইউনিয়নের গ্রাম চৌকিদার সেকেন্দার আলী বলেন, সাধারণ মানুষের নিরাপত্তার জন্য কাজ করি। অথচ আমার বাড়িতে চুরি হয়েছে। আমার বাড়িতে মলমপার্টি ঢুকে তালা ভেঙে টাকা পসয়া নিয়ে পালিয়ে যায়। কয়েক দিন পর পর এমন ঘটনা হচ্ছে। মলমপার্টির ভয়ে রাত জেগে বাড়ি পাহারা দিচ্ছি।
ভজনপুর ইউপি চেয়ারম্যান মসলিম উদ্দিন বলেন, চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার পর মাদক চুরিসহ বিভিন্ন অসামাজিক কাজের বিরুদ্ধে একাধিকবার অভিযান চালিয়েছি। এমন অভিযানে অনেকখানি চুরি কমে গেছে। তবে যারা মাদকাসক্ত তারাই মূলত মলমপার্টি বা বাড়িতে চুরির ঘটনা ঘটাচ্ছে। যারাই এমন কাজে জড়িত থাকুক না কেন আমরা বিষয়টি গভীরভাবে তদন্ত করছি। গ্রামে গ্রামে গ্রাম পুলিশের তৎপরতা বৃদ্ধি করা হয়েছে।
তেঁতুলিয়া মডেল থানার ওসি আবু সাঈদ চৌধুরী বলেন, যেদিন ধরে মডেল থানায় যোগদান করেছি সেদিন থেকেই মাদক, চুরি,জুয়াসহ বিভিন্ন সমস্যা রোধে অভিযান পরিচালনা করছি। তেঁতুলিয়ায় যেন কোনো মানুষের বাড়িতে চুরি কিংবা হয়রানীর শিকার না হয় তার জন্য কাজ করে যাচ্ছি। অজ্ঞান-মলম পার্টির চক্র যদি থেকে থাকে তাদের অব্যশই খুঁজে আইনের আওতায় নিয়ে আনা হবে।