মডেলদের সঙ্গে সম্পর্কের ফাঁদে ফাঁসানোর চাকরি! ব্যর্থ হলেই বৈদ্যুতিক শক
প্রকাশিত : ০৫:৫০ পিএম, ৯ অক্টোবর ২০২২ রোববার
মডেলদের-সঙ্গে-সম্পর্কের-ফাঁদে-ফাঁসানোর-চাকরি-ব্যর্থ-হলেই-বৈদ্যুতিক-শক
নিয়োগপত্র পেয়ে কর্মক্ষেত্রের উদ্দেশে রওনা হন। তবে সেখানে পৌঁছনোর আগেই কেড়ে নেয়া হয় পাসপোর্ট। একইসঙ্গে অজ্ঞাত চুক্তিপত্রে নেয়া হয় স্বাক্ষর। তাই ফেরার সুযোগ হারানোয় গোলকধাঁধার ভেতরে পা ফেলেন তারা। স্টিফেনরা তখনো জানেন না- আগামী ৯৬ দিন কীভাবে কাটবে নরকদর্শন।
গত ৫ অক্টোবর স্টিফেনসহ থাইল্যান্ড থেকে ৪৫ জন ভারতীয়কে উদ্ধার করা হয়েছে। মুক্তি পেয়ে ইংরেজি সংবাদমাধ্যম ‘দ্য টাইমস অফ ইন্ডিয়া’কে দেওয়া ব্যক্তিগত সাক্ষাৎকারে সেই অভিজ্ঞতার কথা জানান স্টিফেন। সাক্ষাতের সময় কথা বলতে বলতে বার বার তার গলা কেঁপে উঠছিল।
স্টিফেন জানান, অফিস বলতে একটি ছোট ঘর। তবে সেখানে ঢোকার আগে সশস্ত্র রক্ষীদের সামনে ৫ মিনিট হাঁটু মুড়ে মাথা নিচু করে বসতে হয়। সেই সময়েই বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছিল চাকরি আসলে কিসের? ঠিক কী কাজ। ধীরে ধীরে স্পষ্ট হচ্ছিল বিষয়টা। বুঝতে পারেন, যে সংস্থায় তারা যোগ দিয়েছেন, তা আসলে ক্রিপ্টোকারেন্সির জালিয়াতি চক্র। তাদের মূল লক্ষ্য ধনী ব্যবসায়ীদের ফাঁদে ফেলে টাকা আদায়।
কীভাবে? স্টিফেনের কথা অনুযায়ী, ধনী ব্যবসায়ীদের উৎসাহিত করতে মডেলদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক করানোর টোপ দেওয়া হত। সেই টোপ সহজেই গিলতেনও তারা।
এ ব্যবসায়ীদের কীভাবে চিহ্নিত করা হত? স্টিফেন জানান, যেসব ব্যবসায়ী ডেটিং অ্যাপে নিজেদের নাম নথিভুক্ত করাতেন, তারাই শিকার হতেন।
স্টিফেনদের কাজ ছিল বিভিন্ন মডেলের নামে ভুয়ো অ্যাকাউন্ট তৈরি করা। ব্যবসায়ীরা যাতে সন্দেহ না করেন সেজন্য বহু নারীকেও কাজে নিয়োগ করত সংস্থাটি। তারাই ঐ ব্যবসায়ীদের সঙ্গে ফোনে কথা বলত। মডেলদের সঙ্গে সম্পর্কের টোপ দিয়ে ব্যবসায়ীদের বিনিয়োগ করতে রাজি করাতেও হত। সেই সব বিনিয়োগের ভিত্তিতে প্রথম প্রথম ভাল রিটার্নও পেতেন ব্যবসায়ীরা। তবে তারও নিয়ম ছিল।
১০০-২০০ ডলার বিনিয়োগ করলে তার রিটার্ন পেতেন ব্যবসায়ীরা। কিন্তু কোনো গ্রাহক যদি ১০ হাজার ডলারের বেশি বিনিয়োগ করতেন, তবে তার পুরো টাকা নিয়ে তাকে ব্লক করে দিত সংস্থাটি।
স্টিফেনদের মতো কর্মীদের কাজ ছিল প্রতিদিন এমন অন্তত ৫০ জনের সঙ্গে যোগাযোগ তৈরি করা। এটাই ছিল প্রতিদিনের লক্ষ্য। আর সেই লক্ষ্য পূরণ না করলেই জুটত কড়া শাস্তি। বন্দুকধারীদের পাহারার মধ্যেই চলত কাজ। শাস্তি দেওয়ার দায়িত্বও ছিল তাদেরই। যে সমস্ত কর্মী লক্ষ্যপূরণ করতে পারতেন না বা কাজ করতে চাইতেন না, তাদেরই দেওয়া হত শাস্তি। রক্ষীদের সঙ্গে থাকত বিদ্যুতের ব্যাটন। সেই ব্যাটনের বৈদ্যুতিক শক দিয়ে অবাধ্য কর্মীদের শাস্তি দেওয়া হত। মানসিক অত্যাচারের পাশাপাশি নিরন্তর চলত শারীরিক নিগ্রহ।
স্টিফেন জানান, ঐ অফিসে ১৬ ভারতীয় কাজ করতেন। গত ১৫ অগস্ট তাদের উদ্ধার করে মায়ানমার সেনারা। কিন্তু তারপরও তাদের দুর্ভোগ শেষ হয়নি। উদ্ধার করার পর সবাইকে সদর দফতরে রাখে সেনাবাহিনী। তারপর নিভৃতবাসে রেখে ১৬ জনের ভারতীয়ের পাসপোর্ট এবং মোবাইল উদ্ধার করে আনে সেনাবাহিনী। এরপর স্টিফেনদের কাছের বাস স্ট্যান্ডে যাওয়ার রাস্তা বলে দিয়ে ছেড়ে দেয় সেনারা।
স্টিফেন জানান, যাওয়ার সময় ব্যাংকক থেকে দু’টি ট্যাক্সিতে তুলে আনা হয়েছিল। পরে পথে একটি জঙ্গলের মধ্যে নামিয়ে দেওয়া হয়। সেখান থেকে আবার দু’টি ট্রাকে করে জঙ্গলের রাস্তা দিয়ে একটি নদীর ধারে পৌঁছান তারা। নৌকেয় করে সেই নদী পেরিয়েই তারা পৌঁছেছিলেন ঐ কর্মক্ষেত্রে। ফেরার সময় সেভাবেই এগোতে থাকেন তারা। কিন্তু ঐ জঙ্গলের রাস্তাতেই তাদের গ্রেফতার করে পুলিশ। আবার কেড়ে নেয়া হয় পাসপোর্ট-মোবাইল। ১৫ দিন পুলিশের হেফাজতে থাকতে হয়। তারপর আদালতে তোলা হয় তাদের। হয় জরিমানা ও ১৬ দিনের হেফাজতও।
স্টিফেন আরো জানান, সেই দিনগুলোতে প্রতিমুহূর্তে তাদের সঙ্গে অপরাধীদের মতো আচরণ করা হয়েছে। অথচ কারো কোনো দোষই ছিল না। শেষে ভারতীয় দূতাবাসের হস্তক্ষেপে ৯৬ দিন পর দেশে ফেরেন স্টিফেনরা। তবে ৯৬ দিনের সেই দুঃস্বপ্ন এখনো তাড়া করে বেড়াচ্ছে সবাইকে।
সূত্র- আনন্দবাজার পত্রিকা।