মাল্টায় মুক্তারের সাফল্য
প্রকাশিত : ১২:১৫ পিএম, ৮ অক্টোবর ২০২২ শনিবার
মাল্টায়-মুক্তারের-সাফল্য
লক্ষ্মীপুরের রায়পুর চরলক্ষ্মী ইউপির হাজিমারা গ্রামে সাড়ে ৮ একর জমির ওপর বাণিজ্যিকভাবে গড়ে উঠেছে মাল্টা বাগান। মুক্তারের সাফল্য দেখে দিন দিন মাল্টা চাষে আগ্রহী হয়ে উঠছে স্থানীয় বেকার যুবকরাও। সারি-সারি মাটির উচু লেন, তার ওপরেই সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে রয়েছে কয়েক হাজার মাল্টা গাছ। বর্তমানে এ বাগানে ১৫০০টি মাল্টা ফলের গাছ রয়েছে। উৎপাদিত মাল্টা বাজারজাত করে প্রতিবছর সাফল্য দেখছেন তরুণ কৃষি উদ্যোক্তা রেজাউল করিম মুক্তার। তিনি লক্ষ্মীপুর পৌরসভার ১৫ নম্বর ওয়ার্ডস্থ বেড়ীর মাথা নামক এলাকার বাসিন্দা।
‘ইউটিউব’ দেখে নিজের মেধা খাটিয়ে গড়ে তুলেন এ বিশাল মাল্টা বাগান। এজন্য তিনি ৮০ লাখ টাকা পারিবারিকভাবে মূলধনও পান। তার এ বাগানকে ঘিরে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হয়েছে ১৫-২০ জন বেকার মানুষের। এদিকে লক্ষ্মীপুরের প্রত্যন্ত অঞ্চলে প্রশিক্ষণহীন এক যুবকের কৃষিতে এমন সাহসিক সাফল্য দেখে অভিভূত খোদ জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর। মাল্টার ফলন বৃদ্ধিতে সার্বিক সহযোগিতার আশ্বাস দিচ্ছেন সংশ্লিষ্ট কৃষি বিভাগ।
জানা যায়, ২০১৬ সালে মাধ্যমিক পরীক্ষা উর্ত্তীণের পর কিছু দিন বেকার ঘুরাঘুরি করেন মুক্তার। প্রবাসী বড় ভাই আজিম ভূঁইয়ার উৎসাহ উদ্দীপনায় ঝুঁকে পড়েন মাল্টা চাষে। বিগত ৫ বছর আগে আত্মীয়দের কাছ থেকে সাড়ে ৮ একর জমি ১০ বছরের চুক্তিতে ১২ লাখ টাকা বিনিময়ে ভাড়া নেন তিনি। এরপর ইউটিউব দেখে-দেখে মাল্টা চাষের উপযোগী করে তুলতে তৈরি করেন সমতল থেকে উঁচু উঁচু মাটির লেন। যা বর্ষায় মৌসুমেও পানিমুক্ত রাখবে মাল্টা গাছকে। প্রথমবার ৩ হাজার কলম চারা লাগান ওই বাগানে। কিন্তু কোনো কিছু বুঝে উঠার আগেই হঠাৎ সবগুলো মাল্টা গাছ মারা যায়। এতে সার ও কিটনাশকসহ প্রায় ১০ লাখ টাকার ক্ষতির শিকার হন তিনি। তবে এ লোকশানে তিনি একটুও ভেঙে পড়েন নি। পারিবারিক উৎসাহ ও নিজের আত্মবিশ্বাস থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর সংগ্রামে নেমে পড়েন।
সাফল্যের কথা মাথায় রেখে পুনরায় রাজশাহী থেকে এক বছর বয়সী মাল্টার কলম চারা এনে রোপণ করেন তিনি। সার ও কিটনাশক প্রয়োগসহ নিয়মিত সেচ ও আগাছা পরিচর্যায় বাগানেই ব্যস্ত থাকেন তিনি এবং মজুরি ভিত্তিক নিয়োগকৃত শ্রমিকরা।
শ্রমিকরা জানান, মুক্তারের মাল্টা বাগানের কারণে তাদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হয়েছে। বর্তমানে বাগানে ‘বারি মাল্টা-১’ জাতের প্রায় ১৫০০ মাল্টার গাছ রয়েছে। মাল্টার পাশাপাশি ওই জমিতে ১০০০ বিভিন্ন জাতের আম, বেশ কয়েকটি কমলা, লেবু ও পেঁপে গাছ রয়েছে। এছাড়াও মুক্তারের আরো দুই একর জমিতে ৪ হাজার পেয়ারা গাছের বাগান রয়েছে।
বাগান মালিক রেজাউল করিম মুক্তার জানান, মাল্টা বাগানই আমার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে। প্রথম দু’বছর ফলন আসলেও লাভের আশা না করে তা ছেটে ফেলে দিয়ে মাল্টার চারাগুলোকে বড় হওয়ার সুযোগ দেয়া হয়। তৃতীয় বছর থেকে ফলগুলোকে বড় হওয়ার সুযোগ দেন। এতে তৃতীয় বছরে প্রায় ১০ লাখ টাকার মাল্টা বিক্রি হয় তার। চতুর্থ বছরে অর্থাৎ গত বছর প্রায় ১৫ লাখ টাকার মাল্টা বাজারের আড়ৎ দারদের কাছে বিক্রি করেছেন তিনি। চলতি বছর ফলন ভালো হওয়ায় এবং বাজার দর ভালো পেলে মাল্টা বিক্রিতে ৩০ লাখ টাকা লাভের আশা করছেন তিনি।
তিনি আরো জানান, ১ বছর বয়সী চারা লাগানোর ২ বছর পর থেকেই ফলন আসতে শুরু করে। ফুল, পরাগায়ন এবং খাবার উপযোগী মাল্টা ফল থেকেই ৭-৮ মাস সময় লেগে যায়। এক-একটি মাল্টা গাছের যত্মেও পেছনে প্রায় ৫ হাজার টাকা খরচ হয়েছে তার। সে হারে প্রতি গাছে ৩ থেকে ৪শ টিরও বেশি মাল্টা ফল ধরে। সঠিক যত্ন নিলে এক একটি মাল্টা গাছ ১০ বছর পর্যন্ত ফলন দিয়ে থাকে। তাই মাল্টা চাষে স্বাবলম্বী হওয়ার স্বপ্ন দেখছেন তিনি।
এদিকে নিজ এলাকায় এখন মুক্তার একজন সফল কৃষি উদ্যোক্তার নাম। প্রতিদিন আশপাশসহ দূর দূরান্তের বহু মানুষ ঘুরতে আসেন মুক্তারের মাল্টা বাগান দেখতে। সুন্দর মনোরম পরিবেশে সাজানো গুছানো মাল্টা বাগানে থোকায় থোকায় ঝুলে থাকা মাল্টাগুলো দেখে অভিভুত হচ্ছেন দর্শনার্থীরা। অনেকে বাগান থেকেই কিনে নিয়ে যাচ্ছেন মাল্টা। এর মধ্যে অনেক বেকার যুবক উদ্বুদ্ধ হয়ে নিজেরাও ছোট ছোট মাল্টা বাগান করার চেষ্টা করছেন। মুক্তার তাদের পরামর্শ দিয়ে সহযোগিতা করছেন। এবছর প্রয়োজনীয় বৃষ্টিপাত না হওয়ায় মুক্তারের মাল্টাবাগানে দেখা দিয়েছে সেচ সংকট। তাই সেচ সুবিধার জন্য সরকারের কাছে একটি কৃষি সেচ যন্ত্রের সহায়তার প্রত্যাশা করছেন এই নবীন কৃষি উদ্যোক্তা মুক্তার।
লক্ষ্মীপুর শহরের দালাল বাজার এলাকার মো. বাবুল বলেন, বিশাল বাগানে মাল্টা চাষ হয় এমন কথা শুরু একদিন বিকেলে সহপাটিদের নিয়ে দেখতে আসি। দেখি তরুণ যুবক এতো বড় বাগান করে লাভ করছে। সেই দিনই তার থেকে পরামর্শ নেই। পরে তার দেয়া মাল্টার চারা নিজের পতিত জমিতে মাল্টা রোপন করি। আশা করি কিছু দিনের মধ্যে ফলন আশা শুরু করবে।
রায়পুর পৌর এলাকার রিয়াজ উদ্দিন ও লক্ষ্মীপুরে নুরুল ইসলাম জানান, তারা সবাই এখন মাল্টা চাষি কৃষি উদ্যোক্তা।
এদিকে সম্প্রতি রায়পুরের হাজিমারা গ্রামে তরুন কৃষি উদ্যোক্তা মুক্তারের মাল্টা বাগান পরির্দশে যান লক্ষ্মীপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর এর উপ-পরিচালক ড. মো. জাকির হোসেন ও জেলা কৃষি বিপণন কর্মকর্তা মো. মনির হোসেন। তারা বিশাল মাল্টা বাগান দেখে অভিভূত হন।
জেলা কৃষি কর্মকর্তা বলেন, এমন মাল্টা বাগান, যেমন গাছের গোদ ভালো, তেমনি অধিক ফলন, বিষয়টি মুগ্ধকর। মাল্টা বাগানের ফলন আরো বৃদ্ধির জন্য কৃষি বিভাগ থেকে সব ধরণের সার্বিক সহযোগিতা করা হবে। মুক্তারকে দেখে মাল্টা চাষে আগ্রহী হচ্ছেন অনেকে। এ অঞ্চলে ভালো সম্ভবনা থাকায় মাল্টা চাষে দিন দিন আবাদ বাড়ছে। জেলায় এ বছর প্রায় ২০ হেক্টর জমিতে মাল্টা চাষ হয়েছে বলে জানান তিনি।
জেলাকৃষি বিপণন কর্মকর্তা মো. মনির হোসেন বলেন, মুক্তারের মাল্টার ফলন ভালো হয়েছে। তবে তার বেচাবিক্রিতে কিছুটা সমস্যা হচ্ছে। আমরা আমাদের মাধ্যমে তাকে সহযোগিতা করে যাচ্ছি। বেশ কয়েক টন মাল্টা আমরা নিজেরাই বিক্রি করে দিয়েছি। শুধু তাই নয়, বাইরের মাল্টার চেয়ে এই মাল্টার গুণাগুণ ভালো হওয়ায় ব্যবসায়ীদের উদ্ধুদ্ধ করছি। তারাও মুক্তারের বাগানের মাল্টা বিক্রি করবে।