সংকটের মুখে চীনের অর্থনীতি, বৈশ্বিক মন্দার আশঙ্কা
প্রকাশিত : ০৬:৫০ পিএম, ৬ অক্টোবর ২০২২ বৃহস্পতিবার
সংকটের-মুখে-চীনের-অর্থনীতি-বৈশ্বিক-মন্দার-আশঙ্কা
বেইজিংয়ের প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ৫ দশমিক ৫ শতাংশ অর্জন এখন অসম্ভব বলে মনে হচ্ছে। যদিও কর্মকর্তা লক্ষ্য অর্জনের আবশ্যকতাকে খুব একটা গুরুত্ব দিতে নারাজ। এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত সংকোচন কোনও মতে এড়িয়ে যেতে পেরেছিল চীন। বেশ কয়েকজন অর্থনীতিবিদ এই বছর আর চীনের প্রবৃদ্ধি আশা করছেন না।
যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের মতো মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগামিতা হয়ত মোকাবিলা করছে না চীন। কিন্তু দেশটির আরও বিভিন্ন সমস্যার মুখোমুখি হতে হচ্ছে। ‘বিশ্বের কারখানা’ বলে পরিচিত দেশটির হঠাৎ করে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ক্রেতা কমে গেছে। যুক্তরাষ্ট্রের মতো বড় অর্থনীতির সঙ্গে বাণিজ্যিক উত্তেজনার কারণেও চীনের প্রবৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
একই সময়ে মার্কিন ডলারের বিপরীতে কয়েক দশকের মধ্যে সর্বনিম্ন অবস্থানে রয়েছে চীনা মুদ্রা ইউয়ান। দুর্বল মুদ্রা বিনিয়োগকারীদের উদ্বিগ্ন করছে, যা আর্থিক বাজারে অনিশ্চয়তা বাড়িয়ে দিচ্ছে। এছাড়া এর ফলে অর্থনীতি আরও মুদ্রার প্রবাহ নিশ্চিত করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উদ্যোগকে জটিল করে তুলেছে।
এমন সময় এসব কিছু ঘটছে যখন চীনের কমিউনিস্ট পার্টির কংগ্রেসে প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং তৃতীয়বার নেতা নির্বাচিত হওয়ার পথে রয়েছে। আগামী ১৬ অক্টোবর পার্টির কংগ্রেস শুরু হবে।
ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি এক প্রতিবেদনে চীনের অর্থনৈতিক সংকটের পাঁচটি কারণ তুলে ধরেছে।
বিশৃঙ্খলা বাড়াচ্ছে জিরো কোভিড
উৎপাদন অঞ্চল শেনজেন ও তিয়ানজিনের মতো বেশ কয়েকটি শহরে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার কারণে দেশটির শিল্পখাতের কর্মকাণ্ডকে বাধাগ্রস্ত করেছে। খাদ্য, পানীয়, খুচরো বা পর্যটন খাতে মানুষ অর্থ ব্যয় করছে কম। যা গুরুত্বপূর্ণ সেবাখাতকে চাপে ফেলেছে।
চীনের জাতীয় পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুসারে, সেপ্টেম্বরে দেশটির কারখানায় কর্মকাণ্ড বাড়তে শুরু করেছে বলে উল্লেখ করেছে। তবে এই তৎপরতার নেপথ্য কারণ হলো সরকার অবকাঠামো খাতে ব্যয় বাড়িয়েছে। এবং টানা দুই মাস উৎপাদন না বাড়ার পর এমনটি দেখা যাচ্ছে। বেসরকারি প্রতিবেদনে সেপ্টেম্বরে উৎপাদন কমে যাওয়ার কথা বলার ফলে সরকারের এই দাবি প্রশ্নের মুখে পড়েছে। বেসরকারি জরিপ অনুসারে, চাহিদার কারণে কমছে উৎপাদন, নতুন অর্ডার ও কর্মসংস্থান।
যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশে পণ্যের চাহিদা কমেছে চড়া সুদের হার, মূল্যস্ফীতি ও ইউক্রেনে যুদ্ধের কারণে।
অর্থনীতিকে পুনরুজ্জীবিত করতে বেইজিংয়ের অনেক কিছু করার রয়েছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। কিন্তু তারা বলছেন, জিরো কোভিড নীতির অবসানের আগ পর্যন্ত বড় ধরনের কিছু করার মতো পরিস্থিতি নাই।
এস অ্যান্ড পি গ্লোবাল রেটিংস-এর প্রধান এশীয় অর্থনীতিবিদ লুইস কুইজস বলেন, বাণিজ্য যদি বিস্তৃত না হয় বা মানুষ যদি অর্থ ব্যয় না করতে পারে তাহলে আমাদের অর্থনীতিতে আরও অর্থের প্রবাহের খুব বেশি যৌক্তিকতা নেই।
সরকারি উদ্যোগ অপর্যাপ্ত
আগস্টে স্থবির অর্থনৈতিক অবস্থা নিরসনে উদ্যোগ নিতে শুরু করে চীনা সরকার। ওই সময় ছোট বাণিজ্য, অবকাঠামো ও আবাসন খাতের স্থবিরতা দূর করতে ১ ট্রিলিয়ন ইউয়ানের একটি পরিকল্পনা ঘোষণা করা হয়। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকার কাঙ্ক্ষিত প্রবৃদ্ধি অর্জন ও কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য আরও অনেক কিছু চাইলে করতে পারে।
সম্ভাব্য সরকারি উদ্যোগের মধ্যে রয়েছে অবকাঠামোখাতে বিনিয়োগ, দেশের ক্রেতা, ডেভেলপ এবং স্থানীয় সরকারের জন্য ঋণের শর্ত শিথিল করা এবং পরিবারগুলোর কর কমিয়ে দেওয়া।
কুইজস বলেন, দুর্বল অর্থনীতির নিরিখে সরকারের প্রতিক্রিয়া আগের অর্থনৈতিক সংকটের তুলনায় খুব বেশি আহামরি কিছু না।
আবাসন খাতে সংকট
আবাসন খাতে বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ড কমে যাওয়া ও নেতিবাচক মনোভাবের কারণে প্রবৃদ্ধি মন্থর হয়েছে, এই বিষয়ে সন্দেহের কোনও অবকাশ নেই। অর্থনীতিতে এর বড় ধরনের প্রভাব পড়েছে। কারণ আবাসন ও অন্যান্য খাত থেকে দেশটির জিপিডির এক-তৃতীয়াংশ আসে।
কুইজস বলেন, আবাসন খাতে যখন আত্মবিশ্বাস কম থাকে তখন তা মানুষকে পুরো অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে দ্বিধায় ফেলে দেয়।
নির্মাণকাজ শেষ না হওয়া ভবনগুলোর ঋণের কিস্তি পরিশোধে অস্বীকৃতি জানাচ্ছেন বাড়ির ক্রেতারা। অনেকেই আশঙ্কা করছেন আদৌ তাদের বাড়ির নির্মাণ কাজ হবে কিনা। নতুন বাড়ির চাহিদা কমেছে এবং এর ফলে নির্মাণ খাতে প্রয়োজনীয় আমদানির পণ্যের চাহিদা কমে গেছে।
আবাসন খাতকে চাঙ্গা করতে সরকারের উদ্যোগে পরও এই বছর দেশটির বিভিন্ন শহরে বাড়ির দাম কমেছে ২০ শতাংশের বেশি।
বিশ্লেষকরা বলছেন, আবাসন ব্যবসায়ীরা চাপে থাকায় এই খাতের আস্থা ফিরিয়ে আনতে কর্তৃপক্ষের অনেক কিছু করার রয়েছে।
পরিস্থিতি আরও অবনতি ঘটাচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তন
চীনের শিল্পখাতে দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে চরম আবহাওয়া। আগস্টে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় সিচুয়ান ও মধ্যাঞ্চলীয় চংকিং শহরে খরার পর ভয়াবহ তাপদাহ দেখা দিয়েছিল। এতে শীতাতপ যন্ত্রের চাহিদা বাড়ায় তা বিদ্যুৎ গ্রিডকে চাপে ফেলেছে। এই অঞ্চলটি বিদ্যুতের জন্য মোটামুটি জলবিদ্যুতের ওপর নির্ভরশীল।
আইফোন নির্মাতা ফক্সকন ও টেসলার মতো গুরুত্বপূর্ণ পণ্যের উৎপাদন কারখানাগুলো একই সঙ্গে তাদের কর্মঘণ্টা কমাতে বাধ্য হয়।
চীনের পরিসংখ্যান ব্যুরোর আগস্টের তথ্য অনুসারে, বছরের প্রথম সাত মাসে লোহা ও স্টিল খাতে গত বছরের একই সময়ের তুলনায় মুনাফা কমেছে ৮০ শতাংশ।
জ্বালানি কোম্পানি ও কৃষকদের সহযোগিতা কোটি কোটি ডলার সহায়তা দিয়ে এগিয়ে আসে সরকার।
বিনিয়োগ হারাচ্ছে টেক কোম্পানিগুলো
দুই বছর ধরে চীনের বড় বড় টেক কোম্পানিগুলোর ওপর নজরদারি প্রবৃদ্ধি অর্জনে সহায়ক হচ্ছে না। সম্প্রতি টেনসেন্ট ও আলিবাবা প্রথমবারের মতো আয় কমে যাওয়ার কথা জানিয়েছে। টেনসেন্টের মুনাফা কমেছে ৫০ শতাংশ এবং আলিবাবার মোট আয় অর্ধেকে নেমে এসেছে।
লাখো তরুণ কর্মী কাজ হারিয়েছেন। যা বাড়িয়ে দিয়েছে কর্মসংস্থান সংকট। ১৬ থেকে ২৪ বছর বয়সীদের মধ্যে প্রতি পাঁচ জনে এক জন এখন বেকার। যা দীর্ঘমেয়াদে চীনের উৎপাদনের সক্ষমতা ও প্রবৃদ্ধি হ্রাস করতে পারে।
চীনে পরিবর্তনেরও আভাস পাচ্ছেস বিনিয়োগকারীরা। শি জিনপিং ক্ষমতাকে আরও সুসংহত করতে বেসরকারি খাতে নজরদারি বাড়ানো হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রীয় কোম্পানিগুলো সুবিধা পেতে শুরু করেছে। বিদেশি বিনিয়োগকারীরা অর্থ সরিয়ে নিতে শুরু করেছেন।
আলিবাবা থেকে বড় অঙ্কের বিনিয়োগ প্রত্যাহার করেছে জাপানের সফটব্যাংক। ইলেক্ট্রিক গাড়ি নির্মাতা কোম্পানি বিওয়াইডি-তে থাকা নিজেদের অংশ বিক্রি করে দিচ্ছে ওয়ারেন বাফেটের বার্কশায়ার হেথাওয়ে। এই বছরে ৭০০ কোটি ডলার মূল্যের বিনিয়োগ প্রত্যাহার হয়েছে টেনসেন্ট থেকে।
একই সঙ্গে মার্কিন শেয়ার বাজারে তালিকাভুক্ত চীনা কোম্পানির ওপর নজরদারি বাড়িয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।
এস অ্যান্ড পি গ্লোবাল রেটিংস- এক সম্প্রতিক নোটে উল্লেখ করেছেন, বিনিয়োগের কিছু সিদ্ধান্ত স্থগিত হয়েছে। কিছু বিদেশি কোম্পানি অন্যান্য দেশে তাদের উৎপাদন বাড়ানোর কথা বিবেচনা করছে।
বিশ্ব এই সত্যে অভ্যস্ত হয়ে ওঠছে যে বেইজিং ব্যবসার জন্য আগের মতো উন্মুক্ত নেই। কিন্তু গত কয়েক দশকে চীনকে ক্ষমতাশালী করা অর্থনৈতিক সাফল্যকে ঝুঁকির দিকে নিয়ে যাচ্ছেন শি জিনপিং।
সূত্র: বিবিসি