ঐতিহ্যবাহী হোগল বন ও হোগলা শিল্প
প্রকাশিত : ১০:১৫ পিএম, ১ অক্টোবর ২০২২ শনিবার
ঐতিহ্যবাহী-হোগল-বন-ও-হোগলা-শিল্প
জেলার চার উপজেলার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বুনানো হোগলা নিয়ে এসে এখানকার পাইকারদের কাছে বিক্রি করত। অন্য দিকে প্রয়োজনের তাগিদে জেলার বিভিন্ন এলাকাসহ পাশের জেলা থেকেও ঝালকাঠির হোগলা পট্টি আসত হোগলা কিনতে। সেখান থেকে হোগলা কিনে বা ভাড়া নিয়ে এ শুকনো মৌসুমে জনসভা অথবা মাহফিলে বিছিয়ে জনসাধারণের বসার জন্য বিছানা করে দেয়া হতো।
এ ছাড়াও ঈদুল আজহাসহ বিভিন্ন সময় গরু-মহিষের গোশত কাটাকাটির কাজে হোগলা বিছিয়ে কাজ করা হতো। অপর দিকে মানুষ মারা গেলে তাকেও হোগল পাতার বুনানো হোগলা দিয়ে মুড়িয়ে দেয়া হতো প্রাথমিকভাবে। তারপরে দাফনের সময়ও বাঁশ বিছানোর পরে হোগলা দিয়ে তার ওপর মাটি ফেলে দাফন কাজ শেষ করা হতো।
অপর দিকে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের কীর্তনসহ নানান পার্বনে হোগলার ব্যবহার ছিল অতুলনীয়। এছাড়াও ধান, ডালসহ বিভিন্ন ফসল শুকানোর কাজেও হোগলার ব্যবহার ছিলো জনপ্রিয়। কিন্তু সেই স্টেশন রোডের হোগলা পট্টিতে বর্তমানে একটিও হোগলা পাতার বুনানো হোগলা বিক্রির দোকান নেই। কালের পরিক্রমায় প্লাস্টিকের মাদুর আর পলিথিনের প্রভাবে হারিয়ে যাচ্ছে হোগলা পাতার বুনানো হোগলা। আগাছা পরিষ্কারের নামে নির্বিচারে উজাড় হচ্ছে হোগল বন। জেলার হোগল বনের সংখ্যা অথবা কী পরিমাণ জমিতে হোগলা বন আছে তার সঠিক পরিসংখ্যান নেই জেলা বনবিভাগ ও কৃষি বিভাগে।
জানা গেছে, জেলার উপকূলীয় পরিবারের প্রায় বেশির ভাগ সদস্যই বংশপরম্পরায় হোগলা তৈরির পেশার সঙ্গে জড়িত। কিন্তু বর্তমানে মহাজনদের দৌরাত্ম্য ও ডিজিটালের ছোঁয়ায় হোগলপাতা চাষের জমি কমে এই শিল্প এখন বিলুপ্তির পথে। অথচ প্রয়োজনীয় পৃষ্ঠপোষকতায় এটি হতে পারে দেশের অর্থনৈতিক জোগানদাতা।
হোগলপাতার ইংরেজি নাম সি-গ্রাস বা সামুদ্রিক ঘাস। উপকূলীয় এলাকার মানুষের কাছে এই হোগলা সংসারের দৈনন্দিন কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি বাড়তি আয় রোজগারের একটি মাধ্যম। এক সময় হোগলপাতার ব্যবহার সীমাবদ্ধ ছিল শুধু চাটাই তৈরিতে। সময়ের পরিবর্তনে এই পাতার নানা মাত্রিক ব্যবহার হচ্ছে।
হোগলপাতা দিয়ে বিছানা, দড়ি, ফ্লোরম্যাট, টেবিল, রান্নার সামগ্রী রাখার ঝুড়ি, লন্ড্রি বাসকেট, পেপার, ট্রে, ফলের ঝুড়ি, শোপিসসহ বিভিন্ন পণ্য দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিদেশেও রফতানি হতো। বেত ও বাঁশের চেয়ে দাম তুলনামূলক কম হওয়ায় এসব সামগ্রী তৈরিতে খরচও কম ছিল। পাশাপাশি পচনশীল ও পরিবেশবান্ধব হওয়ায় হোগলার দড়ি দিয়ে তৈরি নানা তৈজসপত্র।
হোগলা শিল্পী রণজিৎ দাস, বালা রানী দাসসহ কয়েকজন জানান, এক সময় হোগলার মাদুর ছিল শৌখিনতার প্রতিক। কিন্তু হোগলপাতার সরবরাহ কম, আধুনিক পণ্যসামগ্রীর আধিপত্য ও প্রয়োজনীয় পুঁজির অভাবে অনেকেই এ পেশা ছেড়ে দিচ্ছেন। শীতের দিনে হিন্দু পরিবারগুলো হোগলার পণ্য তৈরির কাজে নেমে পড়ত সংসারের বাড়তি আয়ের আশায়। গ্রামের কৃষক, দিনমজুর, মুচিসহ অনেকেই এ পেশার সঙ্গে জড়িত। এসব কুটির শিল্পীর অভিযোগ বর্তমানে হোগলপাতার দাম বৃদ্ধি ও মজুরির ন্যায্যমূল্য তারা পাচ্ছেন না বিধায় এ কাজে তারা উৎসাহ হারাচ্ছেন।
রাজাপুর উপজেলার নারিকেল বাড়িয়া গ্রামের হোগলার কারিগর ফাতেমা বেগম জানান, সাধারণত ফাল্গুন-চৈত্র মাসে হোগলাপাতার কাঁদি ডগা লাগানোর উপযুক্ত সময়। জমি চাষ দিয়ে তৈরি করে ছাই, গোবর বা সবুজ সার দিয়ে অন্যত্র থেকে সংগ্রহ করা হোগলাপাতার কাঁদি ডগা এক- দেড় ফুট ফাঁকে ফাঁকে লাইন করে লাগানো হয়। ১৫-২০ দিন পর কাঁদি ডগার গোড়ায় গোড়ায় চারা গজাতে শুরু করে। এই চারা ১০-১২ ইঞ্চি লম্বা হলে নিড়ানি দিয়ে আগাছা পরিষ্কার করে রাসায়নিক সার প্রয়োগ করলে পাতা মোটা ও ১০-১৫ ফুট লম্বা হয়। একবার কোনো জমিতে হোগলপাতার চাষ করলে ওই জমিতে নতুন আর চারা লাগানোর দরকার হয় না। পৌষ মাসে পাতা কেটে ভালো করে রোদে শুকিয়ে আঁটি বাঁধা হয়। এরপর পাতার ওপরের অংশের মোটা আস্তর অংশ তুলে হোগলা বুনানোর কাজ শুরু হয়। সেই মোটা আস্তরকে দড়ি হিসেবে পান ব্যবসায়ীরা ব্যবহার করেন।
তিনি আরো জানান, বাজারে সাধারণত পাঁচ হাত দৈর্ঘ্য ও চার হাত প্রস্ত হোগলার বিছানা তৈরিতে দুই থেকে তিন দিন লাগে। বর্তমানে একেকটি বিছানার দাম ১৫০ থেকে ২০০ টাকা। আর দড়ি তৈরির জন্য বড় এক বান্ডেল হোগলাপাতার দাম ৩০০-৪০০ টাকা, যা থেকে সাড়ে ১০ হাজার ফুটের বেশি দড়ি তৈরি হয় এবং প্রতি ফুট দড়ির আঁটি ১০-১২ টাকা বিক্রি করা হয়। একটি বেতের বাসকেট তৈরিতে খরচ হয় ১২-১৩ শ’ টাকা, আর হোগলপাতা দিয়ে তৈরি করলে খরচ পড়ে মাত্র ২০০ থেকে ২৫০ টাকা।
তাছাড়া হোগলপাতার ফুল বা রেণু সুস্বাদু খাবার হিসেবে মানুষ শখ করে খায়। এর গুঁড়া বাজারে বিক্রি হয় ৮০ থেকে ১০০ টাকা কেজি। তুলনামূলক দাম কম হওয়ায় আন্তর্জাতিক বাজারে হোগলার তৈরি নানা পণ্যসামগ্রীর কদর থাকলেও দুর্লভ বস্তুতে পরিণত হয়েছে হোগলা।
হোগলাপাতার শিল্পের সাথে জড়িত স্থানীয় দরিদ্র পরিবারগুলোর কিছু সমস্যা কাটিয়ে উঠতে পারলে ও রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর পৃষ্ঠপোষকতা ও প্রশিক্ষণ এবং আন্তর্জাতিক বাজারে আরো প্রসার ও পরিচিতি বাড়াতে পারলে দেশের সম্ভাবনাময় ঐতিহ্যবাহী প্রাচীন ও পাশাপাশি বৈদেশিক মুদ্রা এবং এ আয়ের পেশা টিকে থাকবে বলে মনে করে সচেতন মহল।
জানা যায়, আনাচে কানাচে স্যাঁতসেঁতে ভেজা কিংবা খাল-ডোবায় একধরনের লম্বা সবুজ পাতা হোগল গ্রামীণ পরিবেশে জন্মানো একটি বিশেষ উদ্ভিদ। অঞ্চল ভেদে এটি হোগলা, হোগল, ধাড়িপাতা এসব নামে পরিচিত। হোগলা একটি বহুবর্ষজীবী, একবীজপত্রী, বাতাসে পরাগায়িত, হার্ব জাতীয় উদ্ভিদ। অনাদরে অবহেলায় এ উদ্ভিদটি প্রাকৃতিকভাবেই জন্ম নেয়। মাটির নিচের কন্দ (বীজ) থেকে প্রথমে পাতার মোথা কাণ্ড বের হয়। প্রতি গুছিতে সব মিলিয়ে ৮-১২টি পাতা জন্মে। বছর পেরুলে পাতার মধ্যে গোড়া থেকে লম্বা পুষ্প দণ্ডের মাধ্যমে ফুল আসে। ফুল থেকে ফল হয়, ফল থেকে বীজ হয়। বীজগুলো তুলার মতো আঁশের সঙ্গে লেগে থাকে। আরও পরিপক্ক হলে বাতাসে উড়ে ভেসে বেড়ায়।
কোথাও মাটির স্পর্শে এসে অঙ্কুরিত হয়ে নতুন গাছের জন্ম নেয়। হোগলাপাতা গড়ে ৩-৪ মিটার লম্বা হয়। তবে ১-৭ (৩-২৩ ফুট) মিটার পর্যন্ত লম্বা হয়। পাতার প্রস্ত ৬-২৫ মিলিমিটার পর্যন্ত হয়। গুচ্ছমূলী উদ্ভিদ এটি। একবার এর চারা মাটিতে পুতা হলে যুগ যুগ ধরে বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে ছড়াতে থাকে। অপ্রয়োজনীয় পরিত্যক্ত অনাবাদি পতিত জমিতে হয়। এ গাছে সাধারণত কোনো রোগ বা পোকামাকড়ের আক্রমণ করে না। একেবারে অনাদরে অবহেলায় বিনা খরচে বছর শেষে বেশ উল্লেখযোগ্য আয় এনে দেয়।
দেশে এমনও অনেক পরিবার বা চাষিরা আছেন যারা কেবল শুধু হোগল চাষ করে জীবন-জীবিকা চালান। অনেক সময় এগুলো নিজেদের জমিতে চাষ করে না। নদীর ধারে যেখানে মালিকানা বিহীন জন্মে সেখান থেকে কেটে বাজারে বিক্রি করে। কেউ কেউ নিজেদের অনুর্বর জমিতে হোগলার চাষ করেন। ২ বছর পর্যন্ত অনবরত পানি সহ্য করতে পারে এ গাছ।
কৃষিবিদ মাহজুবা তাসনিম ঐশী জানান, সাধারণত হোগলের জমিতে কোনো সারের প্রয়োজন হয় না। তবুও ফেব্রুয়ারি শেষ থেকে মার্চ মাসে একর প্রতি ৫০ কেজি ইউরিয়া, ৪০ কেজি টিএসপি ও ৩০ কেজি এমওপি, ১ হাজার কেজি গোবর উপরি প্রয়োগ করলে অনেক ভালো ফলন পাওয়া যায়। হোগলপাতা শুধু পাতা হিসেবেই কার্যকর না। খাদ্য হিসেবে হোগলের গুঁড়ি বেশ সুস্বাদু খাবারের মূল উপকরণ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। হোগল ক্ষেতে শ্রাবণ-ভাদ্র মাসে ফুল হয়। এ ফুলে সুমিষ্ট ও সুগন্ধি এক প্রকার গুঁড়া পাওয়া যায় যা হোগলার গুঁড়ি নামে পরিচিত। এ গুঁড়ি গ্রাম বাংলার মানুষের মন জয় করেছে বহুদিন আগ থেকে তা এখন শহরের রান্না ঘরে বহু সমাদৃত এবং উপদেয় খাদ্যের তালিকায় স্থান করে নিয়েছে।
তিনি জানান, আমাদের দেশের কৃষকরা নিজেদের অভিজ্ঞতা থেকে বেশ কিছু কৌশল ও বুদ্ধি খাটিয়ে এটিকে আরো নান্দনিক করেছেন। যেমন সকালে বা বিকালে গুঁড়ি ভাঙতে হয়। পাকা গুঁড়ি নরম ঢ্যাবঢেবে হয় এতে প্রচুর পরাগ রেণু থাকে। প্রথমে গুঁড়ি কেটে কাগজে বা পরিষ্কার কাপড়ে ১-২ দিন শুকাতে হয়। এরপর পরিষ্কার পাতিলে বা গামলার মুখে অতি পাতলা কাপড় বেঁধে গুঁড়িতে আস্তে আস্তে টোকা দিতে হয়। এসব গুঁড়ি ২-১ দিন রোদে শুকাতে হয়। কেউ কেউ গুঁড়ি হালকা নিভু নিভু আগুনে ভেজে নেন। তখন খুব সুঘ্রাণ বের হয়। শুকানো গুঁড়ি বায়ুরোধী পাত্রে বছর পর্যন্ত রেখে দেয়া যায়। প্রতি ফুলের মঞ্জুরি থেকে ৫০ গ্রাম গুঁড়ি পাওয়া যায়। হোগলার ৮০-১০০ টি ফুল থেকে ১ থেকে ১.২৫ কেজি গুঁড়ি পাওয়া যায়। এক কেজি গুড়ির স্থানীয় মূল্য ৪৫০-৫০০ টাকা। ১ একর জমি থেকে বছরে ৫-৮ হাজার টাকার গুড়ি সংগ্রহ করা যায়। এ গুঁড়ি থেকে মিষ্টান্ন, ফিরনি, পোলাও, হালুয়া, পায়েশ, সন্দেশ, পিঠা-পুলি, নাড়ু বিস্কুট তৈরি করা হয়।