উদ্বোধনের অপেক্ষায় মধুমতি সেতু
প্রকাশিত : ০৩:১৫ পিএম, ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২২ বুধবার
উদ্বোধনের-অপেক্ষায়-মধুমতি-সেতু
প্রধানমন্ত্রী সম্মতি দিলে অক্টোবর মাসের প্রথম দিকেই উদ্বোধন করা হতে পারে কাঙ্খিত মধুমতি সেতুটি। সেতুটি উদ্বোধন করা হলে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকার লোক ফেরী পারাপারের মতো দুর্ভোগ ছাড়া দ্রুত সময়ে নড়াইলসহ পার্শ্ববর্তী জেলাসমূহের পর্যটন কেন্দ্রগুলিতে যাতায়াত করতে পারবেন।
মধুমতি সেতু পার হয়ে নড়াইল, যশোর, সাতক্ষীরা, মাগুরা, খুলনা সহ বিভিন্ন জেলার মানুষ খুব সহজে ভোগান্তি ছাড়া যাতায়াত করতে পারবে। তাছাড়া বেনাপোল স্থল বন্দর ও সাতক্ষীরার ভোমরা স্থল বন্দরের সঙ্গে রাজধানীর সঙ্গে সরাসরি ও দ্রুত যাতায়াতের ক্ষেত্রে নতুন সেতুবন্ধন তৈরি হবে।
মহান মুক্তিযুদ্ধ, ক্রীড়া, সংস্কৃতি, ইতিহাস ও ঐতিহ্যসহ পর্যটন ক্ষেত্রে সমৃদ্ধ নড়াইল জেলায় দর্শনার্থীদের মনের খোরাক যোগানোর মতো অসংখ্য স্থাপনা রয়েছে।
বিশ্ববরেণ্য চিত্রশিল্পী এসএম সুলতানের বাসভবন নিয়ে গড়ে উঠেছে এসএম সুলতান স্মৃতি সংগ্রহশালা। এখানে আসলে শিল্পী সুলতানের দুর্লভ চিত্রকর্ম ও শিল্পীর কবর রয়েছে।
এছাড়া শিশুস্বর্গ, এসএম সুলতান বেঙ্গল চারুকলা মহাবিদ্যালয়সহ শিল্পী সুলতানের অনেক নির্দশন রয়েছে। চিত্রা নদীর কোলঘেষে জমিদারদের আমলে নির্মিত ইতিহাসখ্যাত বাধা ঘাট, হাটবাড়িয়ায় জমিদার বাড়ি যা বর্তমানে ডিসি পার্ক নামে গড়ে তোলা হয়েছে।
বেসরকারিভাবে গড়ে ওঠা চিত্রা রিসোর্ট, স্বপ্নবীথি, নিরিবিলি পিকনিক স্পট, পানিপাড়ায় অরুনিমা রিসোর্ট গলফ ক্লাব, ডুমদি গ্রামে চারণ কবি বিজয় সরকারের বাসভবন, সিঙ্গাশোলপুর গ্রামে জারী সম্রাট মোসলেম মোল্যার বাড়ি, ইতনা গ্রামে উপন্যাসিক নিহাররঞ্জন গুপ্তের বাড়ি, কালিয়ায় রবিশংকর-উদয় শংকরের বাসভবন যা বর্তমানে জেলা পরিষদের ডাকবাংলো হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
এছাড়া বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ স্মৃতি যাদুঘর ও গ্রন্থাগার, ক্রিকেট অঙ্গনের উজ্জ্বল নক্ষত্র জাতীয় ক্রিকেট দলের সাবেক সফল অধিনায়ক বর্তমান নড়াইল-২ আসনের এমপি মাশরাফী বিন মোর্ত্তজার বাড়িসহ নড়াইল জেলার তিনটি উপজেলায় দেখার মতো আরো অসংখ্য ইতিহাস-ঐতিহ্যখ্যাত স্থাপনা রয়েছে। এছাড়া, পার্শ্ববর্তী জেলা সমূহেও পর্যটকদের নজর কাড়ার মতো অসংখ্য স্থাপনা রয়েছে।
বাংলাদেশ টুরিজ্যম বোর্ডের সদস্য ও টুরিজ্যম রিসোর্ট ইন্ড্রাজিষ্ট্রজ এসোসিয়েশন অফ বাংলাদেশ এর প্রেসিডেন্ট খবির উদ্দিন আহম্মেদ বলেন, পদ্মা সেতু চালুর পর থেকে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের পর্যটন কেন্দ্রগুলিতে দর্শনার্থীদের ভিড় বেড়েছে। করোনার ধকল কাটিয়ে নতুন করে লাভের স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে। কালনায় মধুমতি সেতুটি চালু হলে এ অঞ্চলের পর্যটন খাত আরো এগিয়ে যাবে।
জানা গেছে, দেশের প্রথম ছয় লেনের মধুমতি সেতু এরই মধ্যে যানবাহন চলাচলের জন্য সেতু সম্পূর্ণরূপে প্রস্তুত করা হয়েছে। গত ২২ সেপ্টেম্বর সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এমপি মধুমতি পরিদর্শনে আসেন। এ সময় মন্ত্রী জানান, প্রধানমন্ত্রী সময় দিলে অক্টোবরের যে কোনো দিন মধুমতি সেতটিু উদ্বোধন হবে। এর আগে এই সেতুকে কালনা সেতু বলা বলেও মধুমতি নদীর নামানুসারে সেতুটির নাম ‘কালনা সেতু’ নামকরণ করা হয়েছে।
এখন সেতু চালুর অপেক্ষায় গোপালগঞ্জ, ফরিদপুর, নড়াইল, যশোর, বেনাপোল, সাতক্ষীরাসহ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বেশ কয়েকটি জেলার কোটি কোটি মানুষ। সড়ক ও জনপথ অধিদফতরের ক্রস বর্ডার রোড নেটওয়ার্ক ইম্প্রুভমেন্ট প্রজেক্টের আওতায় জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সির (জাইকা) অর্থায়নে কালনা সেতু নির্মিত হয়েছে।
এরই মধ্যে মধুমতি সেতুর টোল হার নির্ধারণ করা হয়েছে। এক্ষেত্রে বড় ট্রেইলার ৫৬৫ টাকা, তিন বা ততোধিক এক্সসেল বিশিষ্ট ট্রাক ৪৫০ টাকা, দুই এক্সসেল বিশিষ্ট মিডিয়াম ট্রাক ২২৫, ছোট ট্রাক ১৭০ টাকা, কৃষি কাজে ব্যবহৃত পাওয়ার ট্রিলার ও ট্রাক্টর ১৩৫ টাকা, বড় বাসের ক্ষেত্রে ২০৫ টাকা, মিনিবাস বা কোস্টার ১১৫ টাকা, মাইক্রোবাস, পিকআপ, কনভারশনকৃত জিপ ও রে-কার ৯০ টাকা, প্রাইভেটকার ৫৫ টাকা, অটোটেম্পু, সিএনজি অটোরিকশা, অটোভ্যান ও ব্যাটারিচালিত তিন চাকার যান ২৫ টাকা, মোটরসাইকেল ১০ টাকা এবং রিকশা, ভ্যান ও বাইসাইকেল পাঁচ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে।
উদ্বোধনের পর প্রথমে ম্যানুয়্যাল পদ্ধতিতে টোল আদায় করা হবে। পরবর্তীতে ডিজিটাল পদ্ধতিতে টোল আদায় হবে। এক্ষেত্রে প্রায় একমাস সময় লাগবে। অপারেটরের মাধ্যমে টোল আদায় হবে।
মধুমতি সেতুর প্রকল্প ব্যবস্থাপক এবং সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর (সওজ) নড়াইলের নির্বাহী প্রকৌশলী আশরাফুজ্জামান বলেন, মধুমতি দেশের প্রথম ছয় লেনের সেতু। নেলসন লোস আর্চ টাইপের (ধনুকের মতো বাঁকা) সেতু এটি। সেতুটির দৈর্ঘ্য ৬৯০ মিটার এবং প্রস্থ ২৭ দশমিক ১ মিটার। উভয় পাশে ছয় লেনের সংযোগ সড়ক প্রায় সাড়ে ৪ কিলোমিটার। সেতু নির্মাণে মোট ব্যয় প্রায় ৯৬০ কোটি টাকা। এশিয়ান হাইওয়ের ওপর অবস্থিত এটি। সড়ক যোগাযোগের ক্ষেত্রে সিলেটের তামাবিল হয়ে ঢাকা, ভাঙ্গা, নড়াইল, যশোর, বেনাপোল, কোলকাতা পর্যন্ত সরাসরি ভূমিকা রাখবে।
এতোদিন কালনা পয়েন্টে মধুমতি নদী ধারা বিছিন্ন ছিল। সেতু নির্মাণের ফলে সেই বিছিন্নতা আর রইল না। কালনা সেতু চালু হলে শুধু জাতীয় ক্ষেত্রেই নয়, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখবে। ভারত, কোলকাতা, আসামসহ দেশের মধ্যে সাতক্ষীরার ভোমরা স্থলবন্দর, বেনাপোল ও নোয়াপাড়া নদীবন্দরের মধ্যে যোগাযোগের মাইলফলক রচিত হবে। নড়াইলের লোহাগড়ায় ইপিজেড (রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল) চালুসহ ব্যবসা-বাণিজ্যের সম্প্রসারণ ও ব্যাপক কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে।
কালনাঘাটে স্থাপিত নামফলক থেকে জানা যায়, ২০১৫ সালের ২৪ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ‘কালনা সেতু’র ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। কালনাঘাট থেকে ঢাকার দূরত্ব মাত্র ১০৮ কিলোমিটার। ফলে ঢাকার সঙ্গে নড়াইল, বেনাপোল, যশোর, খুলনাসহ আশেপাশের সড়ক যোগাযোগ কোথাও ১০০ কিলোমিটার, কোথাও আবার ২০০ কিলোমিটার কমে যাবে।
তবে ঢাকা থেকে ফরিদপুরের ভাঙ্গা পর্যন্ত ‘এক্সপ্রেস ওয়ে’ নির্মাণ করা হলেও ভাঙ্গা থেকে বেনাপোল পর্যন্ত এ ধরণের সড়ক নির্মিত হয়নি। ফলে ‘এক্সপ্রেস ওয়ে’র সুফল পাচ্ছে না দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বড় একটি অংশ। ভাঙ্গা থেকে নড়াইল-যশোর-বেনাপোল পর্যন্ত বর্তমানে দুই লেন সড়ক চালু আছে। এই অংশে ‘এক্সপ্রেস ওয়ে’ সড়ক নির্মাণের বিষয়টি প্রকল্পাধীন বলে জানিয়েছেন কালনা সেতুর প্রকল্প ব্যবস্থাপক আশরাফুজ্জামান।
তিনি বলেন, কালনা সেতু চালু হলে যানবাহনের চাপ বেড়ে যাবে। তাই আপাতত যশোরের মনিহার সিনেমা হল চত্বর থেকে নড়াইলের কালনাঘাট পর্যন্ত ৫২ কিলোমিটার সড়ক প্রশস্ত করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। বর্তমানে সড়কটি ১৮ফুট প্রশস্ত থাকলেও তা বাড়িয়ে ২৪ ফুট করা হবে। দরপত্রের কাজ শেষ পর্যায়ে রয়েছে। দরপত্র অনুমোদন হলে ওয়ার্ক অডার দেয়া হবে। এক্ষেত্রে এক মাস সময় লাগতে পারে। নড়াইল অংশে প্রায় ৪৭ কোটি এবং যশোর অংশে ৩২ কোটি টাকা ব্যয়ে সড়ক প্রশস্তকরণ করা হবে। এক বছরের মধ্যে কাজ শেষ করা হবে। এ লক্ষ্যে সড়কের দুই পাশে গাছকাটার কাজ শুরু হয়েছে।
যশোর জেলা পরিবহন সংস্থা শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের খুলনা বিভাগীয় আঞ্চলিক কমিটির যুগ্মসাধারণ সম্পাদক সেলিম রেজা মিঠু বলেন, মধুমতি সেতু চালু হলে যশোর, বেনাপোল, সাতক্ষীরা, মেহেরপুর, মাগুরাসহ পাশের জেলাগুলোর সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা বদলে যাবে। খুব সহজেই রাজধানী ঢাকার সঙ্গে যাতায়াত করা যাবে। পর্যটন খাতসহ সামগ্রিক ব্যাপক উন্নয়ন সাধিত হবে। আমরা কালনা সেতু উদ্বোধনের অপেক্ষায় আছি।
এ অঞ্চলের সবাই তাকিয়ে আছেন মধুমতি সেতু উদ্বোধনের অপেক্ষায়। প্রধানমন্ত্রী দ্রুত উদ্বোধনের দিনক্ষণ ঘোষণা করবেন-এমন প্রত্যাশা সবার।