ম্যারাডোনা, নাপোলির সেই `কীর্তিমানের মৃত্যু নেই`
প্রকাশিত : ০৬:৩০ পিএম, ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২২ মঙ্গলবার
ম্যারাডোনা-নাপোলির-সেই-কীর্তিমানের-মৃত্যু-নেই
সাধারণত কারো মৃত্যু হলে আমরা দুইদিন পর তাকে ভুলে যাই। পৃথিবীতে কেউ তাকে আর স্মরণ করে না। স্মরণ করার মতো কোনো মহৎকর্ম তার থাকে না বলেই। কিন্তু কিছু মানুষকে আমরা তো বটেই মহাকাল অবধি পৃথিবীও মনে রাখে। কেবল তাদের কীর্তির মাঝেই তারা বেঁচে থাকেন যুগ যুগ। এরা কীর্তিমান। নশ্বর পৃথিবীতে কীর্তিমানের কর্ম অবিনশ্বর।
দেহের মৃত্যু হলেও কর্মের মৃত্যু নেই। মৃত্যুর পর থেকে শত শত বছর পরেও কীর্তিমান মানুষের অমর অবদানের কথা মানুষ স্মরণ করে শ্রদ্ধাভরে।
ইতালি প্রাচীন সভ্যতার এক অনন্য নগরী। নানা ভাস্কর্য আর শৈল্পিক নিদর্শন ছড়িয়ে আছে পুরো ইতালিজুড়ে। যেখানে প্রকৃতি-ইতিহাস-ঐতিহ্যের মেলবন্ধনের দেখা মেলে। এই নগরীরই প্রাচীন হাজার বছরের পুরনো শহর নেপলস। নেপলস শুধু ইতিহাস ঐতিহ্যের নয় এটি ইতালির অর্থনীতির বৃহত্তম ও গুরুত্বপূর্ণ এক শহর।
যা ইতালির পশ্চিম উপকূলে অবস্থিত। এর ঠিক মুখোমুখি অবস্থানে রয়েছে নীল জলরাশির টাইরের্নিয়ান সাগর। শহরটির কাছাকাছিই রয়েছে আগ্নেয়গিরি ভিসুভিয়াস পর্বত।
এই শহরেরই ফুটবল ক্লাব নাপোলি। শহরটির নামে থেকেই জনপ্রিয় এই ক্লাবটির নামকরণ করা হয়। ১৯২৬ সালের ২৫ আগস্ট যখন নাপোলি প্রতিষ্ঠিত হয় তখনো ক্লাবটির গায়ে 'জনপ্রিয়' শব্দটার তকমার বিন্দুমাত্ররও প্রলেপ পড়েনি। তবে যখন পড়া শুরু করলো, তখন ইতালি ছাড়িয়ে বিশ্বজুড়েও ধ্বনিত হলো নাপোলির নাম। আর এই কাজটা প্রায় একাই করলেন ছোটখাটো গড়নের একটা মানুষ। নাম তার ডিয়েগো আরমান্ডো ম্যারাডোনা।
জন্ম তার ইতালি থেকেও হাজার মাইল দূরের এক দেশ আর্জেন্টিনার শহর বুয়েন্স আয়ারসে। কিন্তু বাম পায়ের জাদু আর অমর কীর্তিতে তিনি হয়ে উঠেছিলেন নাপোলির ঘরের সন্তান। নাপোলিয়ানদের কাছে দেবতাতুল্য।
১৯৮২ বিশ্বকাপের পর বার্সেলোনায় যোগ দেন ম্যারাডোনা। নীল মেরুন জার্সিধারীদের শিবিরে সময়টা ভালোই কাটছিলো। কিন্তু বাধ সাধে ইনজুরি আর উদ্দাম জীবনযাপন। যার কারণে দুই মৌসুম খেলে ন্যু ক্যাম্পে আর মন টিকেনি তার। এরপর রেকর্ড ট্রান্সফার ফিতে যোগ দেন ইতালির ক্লাব নাপোলিতে।
এরপরের সময়টা কেবল স্বপ্নীল। গল্পটা নাপোলির ঘরের ছেলে হয়ে ওঠার। চিরকাল নাপোলিবাসীর কাছে ঈশ্বর হয়ে ওঠার। ম্যারাডোনার যখন নাপোলিতে যান নাপোলি তখন রেলিগেশনের ওপর ধুঁকছে। ধুঁকতে থাকা ক্লাবটিকে মাত্র দুই বছরের মধ্যে লিগ শিরোপা এনে দেন তিনি।
স্রেফ একক প্রচেষ্টা আর বাম পায়ের জাদুতে। ১৯৮৯-৯০ মৌসুমে জিতেছেন আরো একটি লিগ শিরোপা, কোপা ইতালিয়া জিতেছেন ১৯৮৯-৯০ মৌসুমে, ইউরোপিয়ান মর্যাদার আসর উয়েফা কাপের (ইউরোপা লিগ) শিরোপা জিতেছেন ১৯৮৮-৮৯ মৌসুমে এবং ১৯৯০ সালে জিতেছেন সুপারকোপা।
সময়টা কেবল মাত্র সাতটা বছর। এই সাত বছরে যে কীর্তি ম্যারাডোনা গড়েছেন তার প্রতিদানে এখনও নাপোলির বাসা বাড়ী, বিশাল ভবন কিংবা শপিংমল গুলোর দেয়ালের ক্যানভাসে তার বিশাল বিশাল চিত্রকর্ম এঁকে রেখেছে নাপোলিবাসী।
নাপোলির মানুষরা তাকে ঈশ্বর ব্যতীত অন্য কিছু ভাবে না। তাইতো ম্যারাডোনা বিদায় নেবার পর তার সম্মানে ১০ নম্বর জার্সিটা আজীবনের জন্য তুলে রেখেছে ইতালির বিখ্যাত ক্লাবটি।
পৃথিবীর বুঁকের প্রত্যন্ত অঞ্চলের দেশগুলোয় তখন ফুটবল তেমন প্রচলিত নয়। খেলাধুলা জিনিসটাও তেমন পরিচিত নয়। এমন সময় হুট করেই পুরো বিশ্বে যে মানুষটি ফুটবল নামক ক্রেজ ছড়িয়ে দিয়েছিলেন তিনি ডিয়েগো ম্যারাডোনা।
বাংলাদেশের মতো একটা দেশ পর্যন্ত তখন তার সৃষ্ট ক্রেজে উন্মাদনায় মেতেছে। প্রেমে পড়ে গেছে ষোল আউন্সের এক চর্মগোলকের খেলার। যে মোহের জালে বন্দি হয়ে রাত জাগতেও কারো আপত্তি ছিলো না।
১৯৮৬ ফুটবল বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনাল। আর্জেন্টিনার প্রতিপক্ষ ইংল্যান্ড। প্রথমার্ধে দুই দলই গোলশূন্য কাটানোর পর দ্বিতীয়ার্ধ শুরুর ছয় মিনিটের মাথায় আসে সেই ঐতিহাসিক এবং বিতর্কিত মুহূর্ত। ডি-বক্সের বাইরে ম্যারাডোনা বলটি ঠেলে দেন সতীর্থ জর্জ ভালদানোর দিকে। জর্জ ভালদানোর পাশেই ছিলেন ইংলিশ ডিফেন্ডার স্টিভ হোগ। তিনি চেয়েছিলেন বলটি ক্লিয়ার করতে। কিন্তু অসাবধানবশত বলটি লাফিয়ে উঠে চলে গেলো ইংলিশ গোলকিপার পিটার শেলটনের দিকে। পাশেই ছিলেন সুযোগসন্ধানী ডিয়েগো ম্যারাডোনা। একপর্যায়ে লাফিয়ে উঠলেন দুজনই। একজন গোল ঠেকানোর জন্য অন্যজন গোল করার জন্য। লাফিয়ে উঠার পরমুহূর্তেই হেডের পাশাপাশি বলে আলতো করে বাম হাতও ছুঁইয়ে দেন ম্যারাডোনা। আর তাতেই সৃষ্টি হয় এক স্মরণীয় বিতর্কিত গোল 'হ্যান্ড অব গড'।
এই বিতর্কিত গোল নিয়ে যখন আলোচনা চলছে ঠিক তার চার মিনিট পরই এমন এক গোল করলেন ম্যারাডোনা। যা তাকে ইতিহাসের বুঁকে অমর করে রেখেছে মহাকাল অবধি। যা কিনা আজও স্মরণীয় হয়ে আছে 'গোল অব দ্য সেঞ্চুরী' হিসাবে। প্রায় ৬০ মিটার দূর থেকে ড্রিবলিং করে পাঁচজন ইংরেজ ডিফেন্ডারকে পাশ কাটিয়ে বাম পায়ের জাদুতে বোকা বানান গোলকিপার পিটার শেলটনকেও। এরপর আর কি! বল পৌঁছে গেলো তার গন্তব্যে। এই গোলের পর ফ্রান্সের বিখ্যাত নিউজপেপার 'এল একুইপ' ম্যারাডোনা আখ্যা দিয়েছিলো 'Half angel, Half devil' অর্থাৎ 'অর্ধেক দেবতা, অর্ধেক অমানুষ'!
২০২০ সালটা যেন বিষে ভরা বিশ। সব অর্থেই যেন এটি ভুলে যাওয়ার মতোই একটা বছর হয়ে থাকল গোটা বিশ্ববাসীর কাছে। প্রথমে করোনা ভোগাল সবাইকে, মাঝে কেড়ে নিলো কত কীর্তিমানকে আর বছর শেষের আগে বিষাদে পূর্ণ করলো ষোলকলা।
২৫ নভেম্বর ২০২০ বুধবার, বাংলাদেশ সময় রাত পৌনে ১১টা। হাজার মাইল দূরের আর্জেন্টিনায় হঠাৎ বেজে উঠলো বিউগলের করুণ সুর। সে সুর বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়তে খুব একটা সময় নিলো না। যে সুরের প্রতিটা আর্তনাদ আরো করুণ থেকে করুণতর হয়ে জানাচ্ছিলো এক ভয়াবহ সংবাদ, ডিয়েগো ম্যারাডোনা আর নেই!
মুহুর্তে স্তব্ধ হয়ে গেলো পুরো বিশ্ব। স্তব্ধ হয়ে গেলো বুয়েন্স আয়ারস। স্তব্ধ হয়ে গেলো নাপোলী। বিশ্বজুড়ে ফুটবলের জাদু ছড়িয়ে দেয়া মানুষটা আর নেই, এ যেন কারোরই বিশ্বাস হতে চাচ্ছিলো না। পৃথিবীর প্রতিটা পদক্ষেপ যেন থেমে গেলো মুহূর্তে। বেঁজে উঠলো গীর্জার ঘন্টা। নাপোলির রাস্তায় নামলো আর্তনাদের ঢল। ছলছল চোখে নাপোলিবাসী তাকিয়ে রইলো দেয়ালের ক্যানভাসের দিকে। ঐ তো তাদের ফুটবলের দেবতা, ঈশ্বর। যিনি শহরের ক্লাবটাকে নিজ হাতে চিনিয়েছেন ইউরোপ সহ সারাবিশ্বে।
কে বলছে তিনি নেই। ম্যারাডোনা অমর তার কীর্তির মাঝে। ম্যারাডোনা অবিনশ্বর তার 'হ্যান্ড অব গড' কিংবা 'গোল অব দ্য সেঞ্চুরী'র মাঝে। তিনি অমর বাম পায়ের জাদুতে পুরো বিশ্বের প্রজন্ম থেকে প্রজন্মকে মোহময় করে রাখার মাঝে।
নাপোলির ক্যাবিনেটে শোভা পাওয়া দুই লিগ শিরোপা আর এক উয়েফা কাপের মাঝেও তিনি বেঁচে থাকবেন তার আপন কীর্তিতে। তিনি চির অমর, নাপোলিবাসী থেকে শুরু মহাকাল অবধি পৃথিবীর মাঝে। হঠাৎ যেন শোকস্তব্ধ পৃথিবীর প্রতিটা প্রান্তে প্রত্যেকের কানে ভেসে আসলো অদৃশ্য এক স্প্যানিশ সুর, "লাস গ্রান্দেস মেন্তেস সন ইনমোর্টালেস" অর্থাৎ 'কীর্তিমানের মৃত্যু নেই'।