গা ছমছমে আলুটিলা গুহা!
প্রকাশিত : ১১:৫৫ এএম, ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২২ শুক্রবার
গা-ছমছমে-আলুটিলা-গুহা
আলুটিলার পাহাড়-প্রকৃতির চিত্র আগে এক রকম থাকলেও এখনকার দৃশ্যপট পুরোটাই ভিন্ন। সম্পূর্ণ নতুন রূপে সাজানো হয়েছে এখানকার চারপাশ। বৌদ্ধ স্থাপত্যে গড়া দৃষ্টিনন্দন তোরণ পার হলেই দুই পাহাড় নিয়ে গড়ে ওঠা পর্যটনকেন্দ্রের শুরু থেকে গা ছমছমে সেই গুহা পর্যন্ত নতুনত্ব ও নান্দনিকতার ছোঁয়া। পাহাড় প্রকৃতির নতুন এই রূপ দেখতে আগে যারা এসেছেন তারাও আবার ফিরে ফিরে আসছেন।
মূল ফটক পেরিয়ে নয়নাভিরাম হাঁটাপথ কিছুটা এগুতেই চোখে পড়বে অনিন্দ্য সুন্দর এক সেতু। এ পাশে পাহাড় ওই পাশে আরেক পাহাড় মাঝে গিরিখাত। সেতুটি সঙ্গম করিয়েছে দুই প্রান্তের পাহাড়কে। সেতুর উপর থেকে তাকিয়ে নিচের দিকটা দেখলে গা শিউরে উঠবে।
সেতুটি পার হতেই গোলচত্বর। সামনেই পাহাড়ের ধাপ কেটে তৈরি করা সিঁড়ি, সুদৃশ্য বসার জায়গা। যেখানটায় বসে দর্শনার্থীরা এক সঙ্গে দেখেন পাহাড় ও চেঙ্গী নদীর পাড়ের জনপদ খাগড়াছড়ি। একসময় প্রাকৃতিক গুহাটি আলুটিলার একমাত্র আকর্ষণ থাকলেও এখন দুই পাহাড়ের চারপাশে ছড়িয়ে আছে নান্দনিকতা। পুরো অঙ্গনে যেন মুগ্ধতা ছড়িয়ে আছে।
খাগড়াছড়ি শহর থেকে আট কিলোমিটার দূরে চট্টগ্রাম-খাগড়াছড়ি সড়কের পাশে সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৬০০ ফুট উঁচু পাহাড়ে আলুটিলা পর্যটনকেন্দ্রের অবস্থান। ২০০ একর জায়গাজুড়ে গড়ে উঠেছে এই পর্যটন কেন্দ্র। প্রতিদিন খাগড়াছড়ি শহর ও উপজেলাগুলো ছাড়াও দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে আসে দর্শনার্থীরা। ছুটির দিন কানায় কানায় থাকে মানুষ।
আলুটিলা পর্যটনকেন্দ্রের টিকিট কাউন্টারের দায়িত্বে থাকা পীযুষ কান্তি ত্রিপুরা বলেন, এখানে প্রবেশ মূল্য ৪০ টাকা। শুক্র-শনিবার এখানে দর্শনার্থী হাজারের ওপরে থাকেন। অন্য সময় প্রতিদিন ৪০০-৫০০ দর্শনার্থী থাকেন।
এখানকার অন্যতম আকর্ষণ লাভ ব্রিজ। দুই পাহাড়কে যুক্ত করতে তৈরি করা হয়েছে ১৮৪ ফুট দীর্ঘ লোহার এই সেতু (ক্যাবল ব্রিজ)। এই সেতুতে আছে কাঁচের বারান্দা। কাঁচের বারান্দা দিয়ে নিচে তাকালে একদম নিচে পাহাড়ের অন্যরকম দৃশ্যের দেখা মিলবে। পাহাড়ের বাঁ দিকে সড়ক ধরে এগিয়ে গেলেই দেখা মিলবে প্রাকৃতিক গুহা ও ভিউ পয়েন্টের। আর ডান দিকের সড়ক ধরে এগোলেই দুই গজ দূরে নতুনভাবে তৈরি করা হয়েছে ভিউ পয়েন্ট কুঞ্জছায়া।
পরিবার, স্বজন ও বন্ধুদের নিয়ে আড্ডা দেওয়ার জন্য তৈরি করা হয়েছে নন্দনকানন। কুঞ্জছায়া আর নন্দনকাননের শুভ্র গোলচত্বর আর বসার বেঞ্চ নজর কাড়ছে দর্শনার্থীদের। এখানে বসে ও দাঁড়িয়ে যেন পুরোটা সময় কাটিয়ে দেওয়া যায় আনায়াসেই। লাভ ভিউ পয়েন্টে দাঁড়িয়ে নিচের জনপদকে দেখতে অসাধারণ লাগে। পুরো খাগড়াছড়ি শহরকে এখান থেকে যেন এক পলকেই দেখা যায়।
এত সব নতুন নান্দনিকতা যোগ হলেও এখনো এখানকার প্রধান আকর্ষণ প্রাকৃতিক শীতল গুহাটি। এ গুহার দায়িত্বে থাকা কিরণ ত্রিপুরা জানান, গুহাটির দৈর্ঘ প্রায় ৩৫০ মিটার। এখানে আসা প্রায় সবাই গুহাটি দেখে যান। কেউ ঢোকেন আবার কেউ সাহস করেন না। কিছুটা সাহস করে গুহায় ঢুকলেই চোখে পড়বে পাহাড়ের ঢালে কাটা সিঁড়ি। সেই সিঁড়ি বেয়ে কিছুদূর যাওয়ার পর চোখে পড়বে বিশাল বটগাছ। শিকড়-বাকল ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে চারপাশে। আরেকটু হাঁটার পরই দেখা মিলবে শীতল আলুটিলা গুহার মুখ। আগে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নামতে হতো গুহামুখে। এখন কাছে যেতেই গা যেন ছমছম করে উঠবে। গুহায় ঢুকে মিনিট কয়েক হাঁটার পর অন্ধকার আরো প্রকট হবে। মুখে হাসি থাকলেও মনে নানা ভয় বাসা বাঁধবে। অন্ধকার সাপ-খোপের ভয়, আবার মনে হবে পাহাড় ভেঙে পড়বে না তো? যেতে যেতে সারা শরীর শীতল হতে থাকবে।
কোনো আলো নেই গুহায়। ঘুটঘুটে অন্ধকার। গুহার ওপর দিক থেকে টিপটিপ পানি পড়ছে; নিচ দিয়ে বইছে শীতল জলধারা। খুব সাবধানে পা ফেলে সামনে এগোতে হবে। সুড়ঙ্গের তলদেশ খুব পিচ্ছিল। তাই খুব সাবধানে বাকি পথ পাড়ি দিতে হবে। বুক ধুকধুক করবে, মনে উঁকি দেবে নানা শঙ্কা। কয়েক মিনিট হাঁটার পরই বাইরের সূর্যের আলো চোখে পড়বে। বুক থেকে বের হবে স্বস্তির নিশ্বাস। গুহার এই কয়েক মিনিটের যাত্রাটি দুঃসাহসিক যাত্রা মনে হব। আবার অনেকের কাছে এটি মামুলি ব্যাপার হয়ে দাঁড়াবে।
স্থানীয় লোকজনের কাছে আলুটিলার এই গুহা ‘মাতাই হাকর’ নামে সুপরিচিত। ত্রিপুরা ভাষায় ‘মাতাই’ শব্দের অর্থ দেবতা আর ‘হাকর’ শব্দের অর্থ গুহা। মাতাই হাকর অর্থ দেবতার গুহা। পাহাড়ের পাদদেশে পাথর আর শিলা মাটির ভাঁজে গড়া এ রহস্যময় গুহা।
আলুটিলার টিকিট কাউন্টারের দায়িত্বে থাকা পীযুষ কান্তি ত্রিপুরা বলেন, এখানকার পরিবেশ আগে এত সুন্দর ছিল না। সম্প্রতি অনেক উন্নয়ন হয়েছে এবং হচ্ছে। সৌন্দর্য বাড়ানোর জন্য পর্যটন মন্ত্রণালয় ও জেলা প্রশাসনের অর্থায়নে আলুটিলার উন্নয়ন কাজ চলছে। ২০২০ সালে ১০ লাখ টাকা ব্যয়ে তৈরি করা হয় ভিউ পয়েন্ট কুঞ্জছায়া। এরপর তৈরি করা হয়েছে তোরণসহ নানা স্থাপনা। এই কেন্দ্রে ৮৫ লাখ টাকা ব্যয়ে তৈরি করা হয়েছে লাভ ব্রিজ। আর এক কোটি ২৫ লাখ টাকা ব্যয়ে অ্যাম্ফিথিয়েটারের কাজ হয়েছে। এছাড়া পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের অর্থায়নে চারতলা একটি গেস্ট হাউজের কাজও চলছে।
লোকমুখে শোনা যায়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় খাগড়াছড়িতে দুর্ভিক্ষ দেখা দিলে এখানকার জনগণ এ পর্বত থেকেই বুনো আলু সংগ্রহ করে তা খেয়ে বেঁচে থাকতো। সেই থেকে এ পর্বত আলুটিলা নামে পরিচিতি লাভ করে। এখনো এখানে নাকি প্রচুর পরিমাণে বুনো আলু পাওয়া যায়।
যেভাবে যাবেন
আলুটিলার অবস্থান খাগড়াছড়ি শহর থেকে ৮ কিলোমিটার আগে। ঢাকা-চট্টগ্রাম থেকে খাগড়াছড়ি শহরে যাওয়ার আগে নেমে দেখে যেতে পারেন এই অনিন্দ্য সুন্দর পাহাড় প্রকৃতি। প্রতিদিন রাজধানীর সায়দাবাদ, কমলাপুর, গাবতলী, ফকিরাপুল, কলাবাগান ও টিটি পাড়া থেকে খাগড়াছড়ির উদ্দেশে হানিফ, শ্যামলী, সৌদিয়া, এস আলম, শান্তি পরিবহনসহ বিভিন্ন বাস ছাড়ে। এসব বাসযোগে খাগড়াছড়ি যাওয়া যায়। আর যদি ট্রেনে যেতে চান তাহলে নামতে হবে ফেনী। সেখান থেকে শান্তি পরিবহন, হিল কিং অথবা হিল বার্ড বাসে চড়ে খাগড়াছড়ি যাওয়া যায়। চট্টগ্রামের অক্সিজেন মোড় থেকেও বাসে খাগড়াছড়িতে যাওয়া যায়। ঢাকা থেকে বাসভাড়া পড়বে ৫০০-৭০০ টাকা। ফেনী থেকে ২০০-২২০ টাকা। চট্টগ্রাম থেকে ২৫০-৩০০ টাকা।