সোমবার   ২৫ নভেম্বর ২০২৪   অগ্রাহায়ণ ১০ ১৪৩১   ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

সাগরের বুকে অনন্য সুন্দর কুতুবদিয়ায় আপনাকে স্বাগত

প্রকাশিত : ১১:৫৫ এএম, ১০ সেপ্টেম্বর ২০২২ শনিবার

সাগরের-বুকে-অনন্য-সুন্দর-কুতুবদিয়ায়-আপনাকে-স্বাগত

সাগরের-বুকে-অনন্য-সুন্দর-কুতুবদিয়ায়-আপনাকে-স্বাগত

সাগরের বুক চিরে আজ থেকে ৬ শত বছর পূর্বে  জেগেছিল কুতুবদিয়া দ্বীপ। প্রকৃতির অফুরন্ত সম্পদ এ দ্বীপকে করেছে মহিমান্বিত। কক্সবাজার থেকে ৮৬ কিলোমিটার দূরে এ দ্বীপ। রহস্যময় এই দ্বীপে মানুষ প্রথম পা রাখে পনেরো শতকে। মধ্য প্রাচ্য থেকে সঙ্গীসাথীদের নিয়ে হযরত কুতুবউদ্দীন নামে এক আধ্যাত্মিক সাধক প্রথম এ দ্বীপে আসেন।  কুতুবউদ্দিনের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতেই দ্বীপের নাম হয় ‘কুতুবউদ্দিনের দিয়া’।

পরবর্তী সময়ে মানুষের মুখে ছড়াতে ছড়াতে তা হয়ে যায়, কুতুবদিয়া। অপরূপ সুন্দর রূপালি এ দ্বীপের বর্তমান জনসংখ্যা প্রায় এক লাখ চল্লিশ  হাজার। এটি কক্সবাজার জেলার একটি উপজেলা-এর ইউনিয়নের সংখ্যা ৬ টি। আয়তন ২১৬ বর্গ কিলোমিটার। দ্বীপের চতুর্দিকে বেড়িবাঁধ রয়েছে ৪০ বর্গ কিলোমিটার।

ভ্রমণ পিপাসু পর্যটকদের জন্য এটি হচ্ছে সৌখিন পর্যটন স্পট।  দেশি-বিদেশি অনেক পর্যটক  কুতুবদিয়া ভ্রমণে আসেন বিশেষ করে শীত মৌসুমে। পেকুয়ার  মগনামা ঘাট থেকে কুতুবদিয়া চ্যানেল হয়ে সহজেই কুতুবদিয়া দ্বীপে পৌঁছানো যায়। কক্সবাজার থেকে সরাসরি স্পিডবোটে বা যাত্রী ও মালবাহী নৌযানে করে কুতুবদিয়া যাওয়া যায়।এ ছাড়া চট্রগ্রাম খাতুন গঞ্জ থেকে ও সরাসরি নৌযানে করে যাওয়া যায় কুতুবদিয়া। 

বাতিঘরের ঝলমলে আলোর বিকিরণ রশ্মি নৌযানকে দিকনির্দেশনা দেয়।দেশের যেকোনো প্রান্তেই থাকুন না কেন, আপনাকে প্রথমে  চট্টগ্রাম শহরে আসতে হবে। এখানকার চান্দগাঁও থানা কিংবা নতুন ব্রিজ থেকে আনোয়ারা, বাঁশখালী দিয়ে পেকুয়া মগনামা বাজারে যেতে পারবেন। এছাড়া চকোরিয়া হয়েও যাওয়ার ব্যবস্থা আছে। ভাড়াটা এখন বেশিই পড়বে। ডিজেলের দাম বাড়ায় ভাড়াটা সম্ভবত বিরক্তিকর পর্যায়ে ঠেকেছে। যাত্রাটা বেশ লম্বা ও ক্লান্তিকর।  একটু  ভোরে রওয়ানা দেয়াটা উত্তম।

মগনামা বাজারে নেমে ব্যস্ত হওয়ার কিছুই নেই। এখানেই আছে ছোটখাটো পর্যটন কেন্দ্র। সন্ধ্যায় সূর্যাস্ত দেখতেই বহু মানুষের ভিড় হয় এখানে। চারদিকে জেটিঘাটে ব্যস্ততার নোনা ঘ্রাণ। ছোট ছোট নৌকা হেলতে দুলতে মাছ ধরতে এগিয়ে যাচ্ছে সমুদ্রে। মগনামা থেকে যেহেতু গন্তব্য কুতুবদিয়া তাই এখানে বেশিক্ষণ সময় নষ্ট না করাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। মগনামা জেটিঘাট থেকে কুতুবদিয়ায় বড়ঘোপ স্টিমারঘাটেও যেতে পারেন অথবা দরবারঘাটে যেতে পারেন। টাকা কম থাকলে চড়ে বসুন ডেনিশ বোটে। আর দ্রুত যেতে হলে স্পিডবোট তো আছেই।   

কুতুবদিয়া চ্যানেল পাড়ি দেওয়ার অভিজ্ঞতা কিছুটা ভিন্ন। ৫ কিলোমিটার দীর্ঘ চ্যানেল সারাবছরই উত্তাল থাকে। তবে শীতে কিছুটা শান্ত থাকে। আসছে শীতে বরং কুতুবদিয়া ভ্রমণের পরিকল্পনা করে নিলে মন্দ হবে না। সমুদ্রের ঢেউ তখন হালকা তালে বোটে দোল দেবে। হাড় কাঁপানো হিম শীতল হাওয়া আপনাকে নেবে কতদূরে! অবশ্য লবনাক্ত আবহাওয়ার কারণে এ দ্বীপে শীত জেঁকে বসতে পারে না। কিছুক্ষণের মধ্যেই দেখতে পাবেন কুতুবদিয়ার সুবিশাল ম্যানগ্রোভ বনভূমি। আধ ঘণ্টার সমুদ্রে ভাসার চ্যালেঞ্জ কিছুটা চ্যালেঞ্জিং তো অবশ্যই। পৌঁছাবেন বড়ঘোপ স্টিমারঘাট।

বড়ঘোপ স্টিমারঘাট সারাদিনই ব্যস্ত। মগনামা ঘাটে যাবেন সেই বোটের জন্যেও ঘণ্টাখানেক অপেক্ষা করতে হবে। দ্বীপের বাসিন্দারা সারাদিন বিভিন্ন পণ্যবাহী নৌকায় যাতায়াত করেন। তবে যদি নৌকার যাত্রা ভালো না লাগে তাহলে ব্যাটারিচালিত রিকশা, অটোতে যেতে পারেন।

কুতুবদিয়ায় গেলে প্রথমেই যা অবাক করবে তা হলো এখানকার রাস্তাঘাট একদম পাকা। যাতায়াত ব্যবস্থা বেশ ভালো। এদিকে তেমন ভারী যানবাহন চলাচল করে না। নেই মানুষের হৈ-হট্টগোল। পাবেন না গাড়ির কালো ধোঁয়ায় বিদঘুটে গন্ধ। দ্বীপের ভ্যান্তরীণ সড়কে চলাচল করে অসংখ্য চাঁদের গাড়ী,অটোরিকশা ও টমটম। চারপাশে অট্টালিকার পাহাড় না থাকায় জায়গাটাও খোলামেলা ও ন্যাড়া দেখায়। শীতে গেলে হিমশীতল বাতাস। নোনা ঘ্রাণে ইতিউতি তাকিয়েই দেখবেন বিস্তীর্ণ লবণের মাঠ। সেই লবণের মাঠে সাদার ওপর সোনা রঙের আলো প্রতিফলিত হচ্ছে। 

লবণের মাঠের পাশেও ফসলের ক্ষেত, শাকসবজি, ফল ফলাদির বিশাল আবাদি জমি। সেখানেও নারী-পুরুষ-শিশুর ব্যস্ততা। পর্যটক কিংবা শহুরে মানুষ নতুন কিছু না। তবু তারা মাথা উঁচিয়ে আপনাকে হাসিমুখে দেখবে। লোকজনের আন্তরিকতা এখানে বেশ। শহরের দমবন্ধ অবস্থায় যেখানে কথা বলার লোকের অভাব, সেখানে সুস্থ নিঃশ্বাসের সন্ধানে কুতুবদিয়ার বিকল্প মেলা ভার।

কুতুবদিয়ায় ঘুরতে হলে আপনাকে নোঙর করতে হবে বড়ঘোপ বাজারে। এমনিতে পর্যটন এলাকা হিসেবে এই জায়গাটি বরাবরই উপেক্ষিত। উন্নত সুযোগ-সুবিধার অপর্যাপ্ততা তাই সহজেই লক্ষণীয়। এখানে ভালো রেস্টুরেন্ট নেই। তবে বড়ঘোপ বাজারেই কিছু ভালো খাবার হোটেল পাবেন। স্থানীয় মাছ, মাংস, শুটকি দিয়ে রান্না খাবার যথেষ্ট তৃপ্তি নিয়েই খেতে পারবেন। আবাসন নিয়ে নেই কোনো দুশ্চিন্তা। মানসম্মত বেশ কয়েকটি হোটেল ছাড়াও রয়েছে সরকারি ডাকবাংলো। ছোট এ দ্বীপটিতে হোটেলে বসেই দেখতে পারবেন সমুদ্রের নীল জলরাশি। দ্বীপের উত্তর পশ্চিম ও দক্ষিণ দিকে বিশাল সমুদ্র তীরবর্তী সৈকত। পূর্ব দিকে খরস্রোতা  কুতুবদিয়া চ্যানেল। এই চ্যানেলে সারিসারি নোঙর করা ফিশিং বোট ও নৌযান। এখানে নেই কৃত্রিম ময়লা আবর্জনা ও গিজগিজে হাল।সমুদ্র তীর ধরে একটু দক্ষিণে গেলেই দেখা মিলবে সারিবদ্ধ ঝাউবন,সামুদ্রিক মাছের ছড়াছড়ি, গাংচিলদের এদিক সেদিক উড়ে বেড়ানোর মনোরম দৃশ্য। অসংখ্য জেলে দেখতে পাবেন, যারা জাল আর মাছ নিয়ে ব্যস্ত সময় পার করছেন। সমুদ্র সৈকতের দিগন্ত জুড়ে বিশাল বালু প্রান্তরে পড়ন্ত বিকেলে শিশু ও যুবকেরা ফুটবল খেলে যাচ্ছে। সমুদ্রের কিনারা ঘেষে রয়েছে শুঁটকি পল্লী বা শুঁটকি মহাল। উপজেলা সদর বড়ঘোপে রয়েছে দেশের সর্ববৃহৎ বায়ু বিদ্যুৎ কেন্দ্র। 

আসছে শীতে বরং কুতুবদিয়া ভ্রমণের পরিকল্পনা করে নিলে মন্দ হবে না। ছবি: দৈনিক প্রভাতীপূর্ণিমার জ্যোৎস্না থাকলেতো তো আর কথায় নেই। মাছ ধরার ট্রলারের মিটিমিটি আলো বিক্ষিপ্ত ভাবে থাকায় মনে হবে যেন তারার সমুদ্র এটি। গভীর সাগরে লাইটার জাহাজের আওয়াজ মন জুড়িয়ে যায়। দিনের আলোতে ঘুরে আসুন লেমশীখালীতে অবস্থিত কুতুব শরীফ দরবার। কুতুবদিয়া ভ্রমণ স্বার্থক করতে দ্বীপের দক্ষিণ ধূরং এলাকায় অবস্থিত বিখ্যাত বাতিঘর ইস্পাতের কৌণিক দণ্ড ব্যবহার করে ১৯৬৫ সালে এই বাতিঘর নির্মাণ করা হয়। এখানে এর অন্তত একশো বছর আগে আরো একটি বাতিঘর নির্মাণ করা হয়েছিল। এ বাতি ঘরের কাজ হচ্ছে  গভীর বঙ্গোপসাগরে থাকা জাহাজ ও মাছ ধরার নৌযানকে পথ দেখানো। অনেক দূরে বাতিঘরের ঝলমলে আলোর বিকিরণ রশ্মি নৌযান সমূহকে দিকনির্দেশনা দিচ্ছে। পুরনো বাতিঘরটি কালের পরিক্রমায় সাগর গর্ভে বিলীন হয়ে যায়। অবশ্য ধ্বংসাবশেষ এখনো দূর থেকে দেখা যাচ্ছে।

কুতুবদিয়াকে  ভ্রমণ পিপাসুদের আদর্শ স্থান বলা হয়। এ দ্বীপ প্রাকৃতিক দুর্যোগ তথা ঘূর্ণিঝড় জলোচ্ছ্বাসে ঝুঁকি প্রবণ এলাকা হলেও রূপে অপরূপা। এ কারণে প্রকৃতিকে খুব কাছ থেকে উপভোগ করতে হলে বৈচিত্রময় কুতুবদিয়ার বিকল্প খূঁজে পাওয়া মুশকিল। শীতে কুতুবদিয়ার মানুষ পিঠাপুলি আর খেজুরের রস নিয়ে ব্যস্ত থাকে। এরা অতিথি পরায়ন। শিক্ষার হার আশি শতাংশের কাছাকাছি। যার অবস্থান  জেলার অন্যান্য উপজেলা থেকে অনেক এগিয়ে। স্বভাবতই কুতুবদিয়ার মানুষ  খুবই মেধাবি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এর কারণ হচ্ছে তারা নির্মল ও মুক্ত হাওয়ায় বেড়ে ওঠে। এ দ্বীপের লোকজন বেশিরভাগ অর্থনৈতিক ভাবে স্বাবলম্বী, উচ্চশিক্ষিত ও শান্ত। তাই মামলা মোকাদ্দমার হার ও খুবই কম। সব মিলিয়ে কুতুবদিয়া হতে পারে পর্যটকদের জন্য নিরাপদ ও মনোমুগ্ধকর ভ্রমণের ঠিকানা।