সোমবার   ২৫ নভেম্বর ২০২৪   অগ্রাহায়ণ ১০ ১৪৩১   ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জুরাছড়ি: রাঙামাটির অচেনা রঙ

প্রকাশিত : ০৭:৫৫ পিএম, ১৭ মে ২০২২ মঙ্গলবার

জুরাছড়ি-রাঙামাটির-অচেনা-রঙ

জুরাছড়ি-রাঙামাটির-অচেনা-রঙ

সবুজ পাহাড় আর নীল জলরাশি আমাদের অভ্যর্থনা জানালো। ছোট্ট একটি ঘাটে আমাদের লঞ্চ ভিড়ল। নামার পর দেখি দাঁড়িয়ে আছে সারি সারি মোটরবাইক। রওনা দিই জুরাছড়ি বাজারের দিকে। পথের দু’পাশে আদিবাসীদের ঘর, প্রাচীন বৃক্ষ আর সবুজের সমারোহ। দূরে দাঁড়িয়ে আছে সারি সারি পবর্তমালা।

রাঙামাটির একটি উপজেলা জুরাছড়ি। এর বাজারটি বেশ ছোট। ১০-১৫টি দোকান রয়েছে। একপাশে উপজেলা পরিষদ। এর পাশেই উপজেলার একমাত্র রেস্তোরাঁ! এটি আলী ভাইয়ের। তিনি দীর্ঘ ৩৫ বছর ধরে এখানে খাবার বিক্রি করছেন। দেখেই স্বাগত জানালেন তিনি। এমনকি ঘোরার কিছু পরামর্শও দিলেন।

জুরাছড়ি খুব একটা পরিচিত জায়গা নয়। অনেকের কাছে রাঙামাটিতে বেড়ানোর জায়গা বলতে সুবলং ঝরনা, ঝুলন্ত সেতু কিংবা নৌকায় চড়ে কাপ্তাই লেকে এক চক্কর! অথচ কাপ্তাই লেকের কোলজুড়ে বসে থাকা জুরাছড়ির  সৌন্দর্য পুরোটাই প্রাকৃতিক। মানুষের হাতে তৈরি কৃত্রিম কোনো সৌন্দর্য এখানে খুঁজে পাওয়া যাবে না। এমনকি জুরাছড়ির পথেরও যে সৌন্দর্য, তা খুবই আলাদা। 

নীলাভ লেক আর সবুজ পাহাড় বেষ্টিত জুরাছড়ির সৌন্দর্যে মুগ্ধ হবেন যে কেউ। এমন দুর্গম প্রান্তিক পাহাড়ে সব সময় খুঁজে পাওয়া যায় বুনো গন্ধ আর নীরবতা। মোটরবাইক ভাড়া করে এক পাহাড় থেকে আরেক পাহাড়, নৌকা নিয়ে লেকের নীলাভ জলরাশির ওপর ভেসে চলা যেন অবর্ণনীয়।

প্রায় চার ঘণ্টা জলরাশিতে ভেসে ঘণ্টাখানেক হাঁটি হাঁটি পায়ে পাহাড় বাওয়াই যায়। নামহীন এই পাহাড়ে আমরা উঠছি উদ্দেশ্য নিয়েই। প্রথমে মনে হয়েছিল সহজেই ওঠা যাবে পাহাড়চ‚ড়ায়। কিন্তু ওঠার পথ বেশ খাড়া। ভেজা শরীরেও ঘাম ঝরতে লাগল। ক্লান্ত লেক-নদী ছুঁয়ে আসা বাতাসের প্রবাহ পাহাড়ে ওঠার কাজটি কিছুটা হলেও সহজ করল।

জুরাছড়ি, রাঙামাটি। ছবি: নূরুল করীম

৫০ মিনিট ট্রেকিং শেষে উঠলাম পাহাড়চ‚ড়ায়। যেন অন্য রকম শৈল্পিক রূপ এখানে। একপাশে প্রশস্ত কাপ্তাই লেকের বুকে ছোট-বড় দ্বীপপুঞ্জ, আরেক পাশে সমতল ভ‚মিতে মানুষের ঘরবাড়ি। এর আশপাশে সারিবদ্ধ নারিকেল, গর্জন ও জারুল গাছের হাতছানি উপেক্ষা করার মতো নয়। যতই তাকিয়ে থাকি, ততই মুগ্ধ হই! দেশের সবচেয়ে বড় বুদ্ধমূর্তি এই পাহাড়ের চ‚ড়ায় সুবলং শাখা বনবিহারে সাধনানন্দ মহাস্থবীর (বনভান্তে) কমপ্রেক্স। সেখানেই নির্মিত হচ্ছে দেশের সবচেয়ে বড় বুদ্ধমূর্তি। অনেকের মতে, দক্ষিণ এশিয়াতেও এর চেয়ে বড় ‘শুয়ে থাকা’ বুদ্ধমূর্তি নেই। ১২৬ ফুট সিংহশয্য গৌতম বুদ্ধের মূর্তিটির এখনো অনেকখানি কাজ বাকি।

বিহার কর্তৃপক্ষ জানায়, এত বড় ধ্যানরত বুদ্ধমূর্তি দেশে এই প্রথমবারের মতো নির্মিত হচ্ছে। এমনকি দক্ষিণ এশিয়াতেও এর চেয়ে বড় শুয়ে থাকা গৌতম বুদ্ধের মূর্তি আছে কি না জানা নেই। ২০১৬ সালে এটির নির্মাণকাজ শুরু হয়। ২০১৭ সালের জুলাইয়ে এলাকাবাসীর উদ্যোগে কায়িক শ্রমে বুদ্ধমূর্র্তিটির ঢালাই দেওয়া হয়। ওই সময় দূর-দূরান্ত থেকে হাজারো পুণ্যার্থী অংশগ্রহণ করেন।

জানা গেছে, বুদ্ধমূর্তির শরীরের রঙ হবে স্বর্ণের রঙের। থাইল্যান্ড থেকে আনা হবে বুদ্ধমূর্র্তির চোখ ও রঙ। দেশের সর্ববৃহৎ বুদ্ধমূর্র্র্তিটির স্থপতি বিশ্বজিৎ বড়ুয়া, পওতিপদ দেওয়ান ও দয়াল চন্দ্র চাকমা। এটির প্রধান প্রকৌশলী তৃপ্তি শংকর চাকমা ও ডিজাইন করেছেন ভদন্ত বিমলানন্দ স্থবির।

পুরো কমপ্লেক্সটি ঘোরার পর সরাসরি ঘাটেই যেতে হবে। সেখান থেকে জুরাছড়ি ঘাটে যাওয়ার একমাত্র বাহন মোটরসাইকেল। বলে রাখা ভালো, জুরাছড়িতে যাতায়াতের সবচেয়ে ভালো মাধ্যম মোটরসসাইকেল। সিএনজি নামে পরিচিত অটোরিকশাও দেখতে পাবেন। তবে সংখ্যায় খুবই কম ও ব্যয়বহুল।

জুরাছড়িতে রাতযাপনের কোনো ব্যবস্থা নেই। তাই ফিরতে হবে। লঞ্চে বসে আবার রওনা হলাম রাঙামাটির পথে। ফেরার পথে মনে হচ্ছিল, দুর্গমতা কীভাবে ঢেকে রাখে তার প্রকৃতির গোপন সৌর্ন্দয! এই সৌন্দর্যের নিবিড় ডাকে সাড়া দিলে জীবনটি হয়ে উঠবে উপভোগ্য!

যাওয়া ও থাকা 

রাঙামাটির রিজার্ভ বাজার থেকে লঞ্চ করে জুরাছড়ি যেতে হয়। সকাল সাড়ে ৭টা ও দুপুর আড়াইটায় জুরাছড়ির উদ্দেশে লঞ্চ ছেড়ে যায়। 

জুরাছড়ি থাকার ব্যবস্থা নেই। খাওয়ার জন্যও আধুনিক রেস্তোরাঁও নেই। তবে উপজেলা কমপ্লেক্সের পাশে মোহম্মদ আলী হোটেলে সুস্বাদু খাবার মেলে, দামও কম। দিন গিয়ে দিনেই ফিরে আসতে হবে রাঙামাটি শহরে।