সোমবার   ২৫ নভেম্বর ২০২৪   অগ্রাহায়ণ ১০ ১৪৩১   ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ছেঁড়া জ্যোৎস্নায় ধুয়ে যাচ্ছে হিমাচল, কল্পনা নয় সত্যি

প্রকাশিত : ০৩:৫৫ পিএম, ৭ মে ২০২২ শনিবার

ছেঁড়া-জ্যোৎস্নায়-ধুয়ে-যাচ্ছে-হিমাচল-কল্পনা-নয়-সত্যি

ছেঁড়া-জ্যোৎস্নায়-ধুয়ে-যাচ্ছে-হিমাচল-কল্পনা-নয়-সত্যি

কাকডাকা ভোরে দিল্লি স্টেশনে থামলো আমাদের ট্রেন। স্টেশন থেকে বেরোতেই দেখি গাড়ি অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য। গাড়িটির ড্রাইভার এসে বললো, সে শিমলা-মানালি পর্যন্ত ঘোরাতে পারে। কিন্তু দিল্লি থেকে প্রায় ৭৪০ কিলোমিটার দূরে কাজা পর্যন্ত মোটেই যাবে না। আমাদের মাথায় হাত। ওই সময়ে অন্য গাড়ি পাব কোথায়? প্যানিক শেষ হলে ঠিক করা হল, ভাড়ার ট্যাক্সি নিয়ে চণ্ডীগড় পর্যন্ত চলে যাওয়া যাক। সেখানেই একটানা একটা রাস্তা পাওয়া যাবে।

চণ্ডীগড় পর্যন্ত যাওয়া গেল সাড়ে পাঁচ ঘণ্টার রাস্তা পেরিয়ে। মে মাসের পোড়া রোদে এসি গাড়ির ভেতরে বসেও মাথার চাঁদি গরম হয়ে যাওয়ার জোগাড়! চালকের চেনা সূত্রে এক পাঞ্জাবি ড্রাইভারের সন্ধানও পাওয়া গেল, যিনি কাজার ওই দুর্গম পথে আমাদের নিয়ে যেতে রাজি হলেন। বুকে বল পেলাম। গাড়ি গড়াল মসৃণ হাইওয়ে ধরে। ফার্স্ট স্টপ ফাগু পৌঁছলাম রাত ৯টার আশেপাশে। পরের স্টপ কল্পা।

পরের দিন নারকান্ডা পেরিয়ে খানিক যাওয়ার পর থেকেই পথের সঙ্গী হলো সাটলেজ বা শতদ্রু নদী। আরও ১৬০ কিলোমিটার শুধু উৎসাহের ফানুসে ভর করেই কল্পা পৌঁছে গেলাম। পথে পড়লো রেকংপেয়ো। ফোনে ওয়েদার রিপোর্ট বলছে, ৯ ডিগ্রি। কিন্তু হাড় কাঁপানো হাওয়ায় মনে হচ্ছে, মাইনাসে রান করছে!

সকালে দেখা গেল ঝকঝকে রোদ। হাত বাড়ালেই যেন ছুঁয়ে দেওয়া যাবে আইসক্রিম টাবের মতো পর্বতের সারিকে। ফটাফট ফোন বের করে ফেসবুকের ডিপি তুলে নিলো সবাই। কল্পা থেকে বেরোনোর মুখেই শুনেছিলাম, কাজা যাওয়ার রাস্তা কেমন ভালো নয়। তার ওপরে রাস্তাটি (ন্যাশনাল হাইওয়ে ৫০৫) এশিয়ার অন্যতম বিপজ্জনক হাইওয়ে বলেও পরিচিত। যাওয়ার পথে বেশ কিছু ছোট গ্রাম পড়ে। পুহ, নাকো, তাবো। ঘুমন্ত, ছবির মতো। স্লেটের ছাদওয়ালা বাড়ি দিয়ে সাজানো।

কাজায় পৌঁছলাম সন্ধ্যায়। স্পিতি অনেকটা লাদাখের মতোই শীতল মরুভূমি এলাকা। গাছপালা কম, রুক্ষ প্রান্তর, ছোট ‌উপত্যকা... তবে সে সবদিকে তখন মন দিতে পারছি না। সাড়ে ১২ হাজার মিটার উঁচুতে অক্সিজেনের অভাব টের পাচ্ছিলো ফুসফুস। তার উপরে কনকনে ঠান্ডা! মাথায় টিপটিপে একটা ব্যথাও মালুম হচ্ছিল। হাই অল্টিটিউড সিকনেস। হোটেলে পৌঁছেই হিটারের সামনে বসে চা খেয়ে ধাতস্থ হলাম।

হিমাচলের সবকিছুই অসাধারণ। ছবি: সংগৃহীত

কাজায় একটা মজার জিনিস শিখলাম। স্থানীয় ভাষায় ‘জ়ুলে’ শব্দটি ধন্যবাদ, স্বাগত, বিদায়— সবের জন্যই ব্যবহার হয়। স্পিতি ভ্যালি থেকে সুভেনির কিনতে চাইলে কাজা মার্কেটে টি শার্ট, স্টোল, কানের দুল পাবেন। সে সব সেরে এগোলাম কি মনাস্ট্রির দিকে। দ্বাদশ শতকে নির্মিত কি গুম্ফা বহু ইতিহাসের সাক্ষী। পৌঁছে দেখলাম খুদে লামারা ক্রিকেট খেলছে! মনাস্ট্রি ঘুরে দেখে এগিয়ে গেলাম কিব্বরের দিকে। ওয়াইল্ড লাইফ স্যাংচুয়ারির ভেতরে গ্রাম। কপালে থাকলে, স্নো লেপার্ডের সাক্ষাৎ মেলে! তবে কপাল বোধহয় ভাল ছিল... তিনি আর দেখা দিলেন না। ইচ্ছে ছিল, পৃথিবীর সব চেয়ে উঁচু পোস্ট অফিসটাও (হিকিম ১৪,৪০০ মিটার) দেখে আসার। সময় না থাকায় এ যাত্রায় হল না।

কাজা থেকে নেমে রামপুরে এলাম রাতটুকু কাটাতে। পরের দিন বাকি চারজনকে বিদায় জানিয়ে, আমরা রওনা দিলাম কসোলের পথে। পার্বতী নদীর ধারে ছোট্ট হিমাচলি শহর। সারি সারি ক্যাফে, পাব, ট্রেন্ডি জামাকাপড়ের দোকান দিয়ে সাজানো কসোল ম্যাল। সর গরম। ইসরায়েলি ডিনারে স্নিৎজেল আর শাকশুকা খেয়ে সে রাতের মতো হোটেলেই ফিরে এলাম। পরের দিন পৌঁছলাম কসোল থেকে এক ঘণ্টার দূরত্বে ছোট্ট হিমালয়ান গ্রাম তোশে। প্রায় নির্জন। হোটেল পর্যন্ত অল্প হাইকিং করে এগোতে হল। পথে ব্রেক নিয়ে বিখ্যাত জার্মান বেকারিতে কোকোনাট কুকিজ আর কফি কেক খেয়ে নিলাম। তখন থেকেই টিপটিপ করে বৃষ্টি শুরু হয়ে গিয়েছে। হোটেলে পৌঁছতে না পৌঁছতেই নামল মুষলধারে বৃষ্টি।

তোশে দু’দিন বিশ্রামের উপরেই গেল। কলকাতায় ফেরার সময় হয়েই এসেছিল। মন খারাপ। শেষ রাতে বেরিয়ে এলাম হোটেলের ব্যালকনিতে। বৃষ্টি থেমেছে। লোডশেডিং হওয়া তোশ অন্ধকার। কিন্তু তা-ও ঝকঝক করছে! পূর্ণিমার চাঁদ যে আকাশে! তারা বেরিয়ে পড়েছে কয়েক লক্ষ। আর সামনে কালো আকাশের চাঁদোয়া ছেঁড়া জ্যোৎস্নায় ধুয়ে যাচ্ছে হিমালয়... যুগলে হা করে সেই নিসর্গ দেখতে দেখতে গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠলো।