রোববার   ২৪ নভেম্বর ২০২৪   অগ্রাহায়ণ ১০ ১৪৩১   ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

২০০ বছরের খোয়া সাগর দিঘি

প্রকাশিত : ০৩:১৫ পিএম, ১৭ নভেম্বর ২০২১ বুধবার

২০০-বছরের-খোয়া-সাগর-দিঘি

২০০-বছরের-খোয়া-সাগর-দিঘি

২৫ একর এলাকা জুড়ে জেলা সদরের দালাল বাজার সংলগ্ন খোয়া সাগর দিঘি। কুয়াশাকে স্থানীয় ভাষায় বলা হয় ‘খোয়া’। বিশাল জলরাশিময় দিঘির এক প্রান্ত দাঁড়িয়ে অন্য প্রান্তে কুয়াশাময় মনে হতো বলে এর নাম খোয়া সাগর দিঘি। অর্থাৎ খোলা চোখে ভালোভাবে এপার থেকে ওপার দেখা যেতো না। 

ঐতিহাসিক তথ্যমতে আনুমানিক ১৭৫৫ সালে জমিদার ব্রজ বল্লভ রায় মানুষের পানীয় জল সংরক্ষণে এ দিঘিটি খনন করেন। এ দিঘি নিয়ে বহু উপ কথা ছড়িয়ে আছে।

প্রতিদিন বিকেলে ভ্রমণপ্রেমীদের ভিড়ে মুখর থাকে খোয়া সাগর দিঘির পাড়। খোলা আকাশের নিচে মুক্ত প্রকৃতির সান্নিধ্যে থাকতে জেলা শহর থেকে বিভিন্ন বয়সীরা আসেন এখানে। দিঘির জল ছুঁয়ে আসা কোমল হাওয়া তাদের মন ছুঁয়ে যায়। 

ভ্রমণপিপাসুদের ছায়া হিসেবে কাজ করে বেশকিছু কড়ই গাছ। এখানে গল্পে গল্পে দারুণ সময় কাটান তরুণ-তরুণী। অনেকে মোবাইল ফোনে সেলফি তুলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করেন।

এটি লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার লক্ষ্মীপুর-রায়পুর সড়কের পূর্বপাশে জমিদার বাড়ির পূর্ব পাশে অবস্থিত। বিশাল আয়তনের একটি দিঘির নামই খোয়াসাগর দিঘি। 

স্বচ্ছ জল, আকাশের নীলাভ দৃশ্য আর চারপাশের সবুজে ঘেরা অপরূপ প্রকৃতিতে মিশে একাকার লক্ষ্মীপুরের খোয়া সাগর দিঘি। মাছরাঙা, পানকৌড়ি, সাদা বকসহ বিভিন্ন ধরনের পাখির মিলনকেন্দ্র এটি। এখানে বিভিন্ন প্রজাতির অতিথি পাখি জলে ডুব দেয় এবং মাছ শিকার করে ক্ষুধা মেটায়।

প্রকৃতিপ্রেমীরা পাখির কলকাকলি ও ওড়াউড়ির দৃশ্য বেশ উপভোগ করেন। ২৫ একর জমিজুড়ে দিঘিটির সৌন্দর্য মনোমুগ্ধকর। চারপাশে হাঁটার পথ। শীতকালে দিঘির এক পাড় দিঘিটি দেখতে সাগরের মতো। 

আবার বলা হচ্ছে, খোয়া মানে কুয়াশা অর্থাৎ দিঘিটির আয়তনে এতই দীর্ঘ যে এর একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে তাকালে কুয়াশাময় মনে হয় বলে এর নামকরণ হয় খোয়াসাগর।

২০০ বছর আগে আশপাশের এলাকা মাটি ভরাট এবং মানুষের ব্যবহারের জন্য পানি সংরক্ষণের প্রয়োজনে দালাল বাজারের জমিদার ব্রজ বল্লভ রায় দীঘীটি খনন করেন। এই দিঘির ঠিক পাশেই রয়েছে দালাল বাজার মঠ।

জেলার ইতিহাস, ঐতিহ্য ও তথ্যকোষ সমৃদ্ধ গ্রন্থ ‘লক্ষ্মীপুর ডায়েরি’ থেকে জানা যায়, ২০০ বছর আগে দিঘিটি খনন করা হয়। মূলত চারপাশের এলাকার মাটি ভরাট ও মানুষের ব্যবহার্য পানি সংরক্ষণের প্রয়োজনে এই উদ্যোগ নেন তৎকালীন রাজা জমিদার ব্রজ বল্লভ রায়।

দিঘিকে ঘিরে পর্যটনের অনেক উন্নয়নে কাজ করছে জেলা প্রশাসন। ফলে এখন দিঘির পাড়ে গেলে বেশ পরিবর্তন চোখে পড়ে। পর্যটকদের চলাচলের জন্য ইট দিয়ে রাস্তা নির্মাণের পাশাপাশি তাদের বসার ব্যবস্থা করা হয়েছে। রাতে এখানে ল্যাম্প পোস্টের আলোয় গল্প জমে। দিঘির একপাশে মসজিদ। দিঘির সিঁড়িতে পা রেখে স্বচ্ছ জলে হাত-মুখ ধুয়ে নেন কেউ কেউ। কেউবা গোসল সেরে নেন এখানে।

স্বচ্ছ জল, আকাশের নীলাভ দৃশ্য আর চারপাশের সবুজে ঘেরা অপরূপ প্রকৃতিতে মিশে একাকার লক্ষ্মীপুরের খোয়া সাগর দিঘি।

সড়কপথে ঢাকার সায়েদাবাদ বাস টার্মিনাল থেকে লক্ষ্মীপুর শহরের উত্তর স্টেশনে এসে সেখান থেকে সিএনজি অথবা অটোরিকশায় দালাল বাজারে নামলেই পূর্ব পাশে তাকালেই দেখা যায় খোয়া সাগর দিঘি। আবার কেউ যদি নদীপথে আসতে চায়, তাহলে সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনাল থেকে চাঁদপুর পৌঁছাতে হবে। এরপর রায়পুর। তারপর আবারো লক্ষ্মীপুর শহরমুখী সিএনজিতে উঠে দালাল বাজারে এলেই চোখে পড়বে খোয়া সাগর দিঘি। লঞ্চ খরচ যাওয়া-আসা ৫৮০ টাকা। আর বাস বেছে নিলে খরচ পড়বে ৮২০ টাকা।

জানা যায়, একবার এক বরযাত্রী তাদের নববধূকে নিয়ে দিঘির পাড় দিয়ে যাচ্ছিল। সে সময় বর যাত্রীদের পানির পিপাসা পেলে তারা যাত্রা বিরতি দিয়ে দিঘিতে নেমে পানি পান করেন। নববধূও নেমেছিলেন পানি পান করতে। নববধূ যখন অঞ্জলি ভরে পানি পান করতে যাচ্ছিলেন-অমনি তার পা দুটি ধরে কে যেন তাকে নিচের দিকে টেনে নিয়ে যায়। নববধূ আর ফিরে আসেননি। সেই থেকে ওই স্থানটিতে গভীর গর্ত হয়ে আছে। 

দিঘির সিঁড়িতে পা রেখে স্বচ্ছ জলে হাত-মুখ ধুয়ে নেন কেউ কেউ। কেউবা গোসল সেরে নেন এখানে।

প্রচণ্ড খরায় সারা দিঘি শুকিয়ে গেলেও ওই স্থানটি শুকায় না। খোয়া সাগর দিঘির পশ্চিমে কোদাল ধোয়া দিঘি নামে আরেকটি দিঘি আছে। কথিত আছে, খোয়া সাগর দিঘি খনন করে শ্রমিকরা কোদাল ধুতে এসে দৈনিক এক কূপ মাটি কেটে ওই দিঘি খনন করে।

লক্ষ্মীপুরের ডিসি মো. আনোয়ার হোছাইন আকন্দ ডেইলি-বাংলাদেশকে বলেন, জমিদার বাড়ির অংশ বিশেষ দালাল বাজার খোয়া সাগর দিঘির একটি ঐতিহ্য রয়েছে। নাম ডাকের পাশপাশি এটিকে নিয়ে অনেক ইতিহাস গল্পও রয়েছে। সেই ঐতিহাসিক খোয়া সাগর দিঘিকে জেলা প্রশাসনের মাধ্যমে এবং পর্যটন মন্ত্রণালয়ের অর্থায়নে সৌন্দর্য্যবর্ধন করেছি। এটিকে আধুনিকায়ন করে পর্যটন হিসেবে রুপ দেয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। এরই মধ্যে অনেকটা হয়ে গেছে। এখনো পূর্ব পাশ এবং দক্ষিণ পাশের কিছু কাজ বাকী রয়েছে। সেখানেও পরিবর্তন করা হবে। সব মিলিয়ে লক্ষ্মীপুরের এ খোয়া সাগর দিঘিকে কেন্দ্র করে জেলার বাহির থেকেও পর্যটন এসে আনন্দভোগ এবং বিনোদন করতে পারবেন।