মঙ্গলবার   ২৬ নভেম্বর ২০২৪   অগ্রাহায়ণ ১১ ১৪৩১   ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

নীলচে-সবুজ পাহাড়ের কোলে ‘মায়াবী’ শহর

প্রকাশিত : ০৩:৫৫ এএম, ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২১ শনিবার

নীলচে-সবুজ-পাহাড়ের-কোলে-মায়াবী-শহর

নীলচে-সবুজ-পাহাড়ের-কোলে-মায়াবী-শহর

লাওসে বাস করছি—সে বছর দুয়েকের মতো হয়ে গেল। আজকাল লাওদের কথাবার্তা বেশ বুঝতে শিখেছি। এখন আর সবসময় সাথে করে ইন্টারপ্রেটার নিয়ে বেরুতে হয় না। হালফিল একা একা ঘুরে বেড়ানোর প্রবণতাও বাড়ছে। লাওসে শিলাময় পাহাড়-পর্বত বিস্তর, আর কোনো কোনো পাহাড়ের ভেতরভাগে আছে ফাঁপা সব পাথরের ঝুরি নামানো গোলকধাঁধা।

আজ আমি যে পাহাড় দেখতে এসেছি, তা বড়িখামছাই প্রদেশের পাকশান ডিস্ট্রিক্ট টাউনের কাছেই। পা-মোয়াং পাহাড়টি দিগন্ত অব্দি বিস্তৃত সবুজ ধানখেতের মাঝামাঝি যেন পাষাণে গড়া প্রাকৃতিক মনুমেন্ট হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমি পাথরের সার্প সব পিনাকোলের দিকে এক নজর তাকিয়ে ঢুকে পড়ি তার ভেতরের গুহায়। এখানে নানাদিকে চলে গেছে অন্ধাকারাচ্ছন্ন চোয়ানো জলে স্যাঁতসেঁতে সব সংকীর্ণ সড়ক। আমি খানিক ঘুরপাক খেয়ে দেখি, একটি গুহামুখ থেকে হামাগুড়ি দিয়ে বেরিয়ে আসছেন দাঁতপড়া এক বুড়ো। বৃদ্ধ খোশালাপি, তিনি আমাকে নিয়ে ফের গুহায় ঢোকেন। ভেতরে স্পেস অনেক প্রশস্ত। এ যেন আদিম পাথরে গড়া তিন মহলা দরদালান। ছাদ থেকে ঝুলছে বাদুড় জাতীয় পাখ-পাখালি। চোখে অন্ধকার সয়ে এলে বুড়ো বিষয়টি ব্যাখ্যা করেন।

সেকেন্ড ওয়ার্ল্ডওয়ারের সময় যখন মিত্রবাহিনীর বেধড়ক বোমাবর্ষণে জাপানি সৈন্যরা রিট্রিট করছে, তখন জনা পাঁচেক জাপ আর্মি এ গুহায় শেল্টার নেয়। অনেক খোঁজখবর করেও বেশ কিছুদিন পাওয়া যায়নি তাদের কোনো খোঁজ-পাত্তা। বুড়ো মশাল জ্বালিয়ে আমাকে নিয়ে চলেন সুড়ঙ্গের রহস্যময় অন্ধকারে। পথের পাশে পাথর কেটে বেদি বানিয়ে রাখা আছে তিনটি বৌদ্ধমূর্তি। কারা যেন একটু আগে ফল-ফুল ও বনের সবুজ পাতা দিয়ে আরাধনা করে গেছে দেবতার। বুড়ো বিগ্রহকে প্রণাম করে তাদের নিয়ে কিছু কথাবার্তা বলেন। আমি ঠিক ধরতে পারি না মূর্তিরাজির ইতিবৃত্ত। মশালের আলোয় তাদের চোখের তারা যেন ঘুরপাক খায়।

আমরা আরো কিছুটা বন্ধুর পথ উজিয়ে চলে আসি আরেকটি গুহায়। এ গুহাটি ঠিক নির্জন নয়। এখানে ঠিল্লা কাঁখে দাঁড়িয়ে আছে একজন যুবতী মেয়ে। তাঁতের ভেজা রুমাল দিয়ে জড়ানো তার পৃথুলা স্তনযুগল। সে অনেকদিন আগের কথা, এ গুহায় লুকিয়ে ছিল নাঙ পুমহোম বলে আরেক যুবতী, যার চুলের সুগন্ধে মাতোয়ারা ছিল পাঁচ গাঁয়ের সব তাগড়া তরুণ। পাড়া-পড়শির চোখ এড়িয়ে ভিন গোত্রের এক পুরুষের সাথে এখানে ঘর বেঁধেছিল নাঙ পুমহোম। জন্মেছিল তাদের একটি শিশুসন্তানও। তারপর থেকে কোনো যুবতীর ভালোবাসায় দুর্বিপাক দেখা দিলে তারা আসে এ পাহাড়ে। এখানে কোনো জলাশয় নেই। নাঙ পোমহোম বড়ো কষ্টে পাথর ঘষটে, নানা সুড়ঙ্গপথ ধরে, একটি ঠিল্লায় পাষাণ চোয়ানো পানি জমিয়ে নিয়ে আসত তার প্রণয়ের পুরুষ ও বাচ্চাটির জন্য। সে থেকে বিষয়টি যেন রেওয়াজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কোনো তরুণীর প্রণয়ে বিঘ্ন হলে, সে হামাগুড়ি দিয়ে তাঁতের বস্ত্র ভিজিয়ে ঠিল্লা ভরে জল এনে ঢেলে দেয় সঙ্গোপনে, যে শিলায় সুরতলীলায় লিপ্ত হতো নঙ পোমহোম—তাতে। বৃদ্ধের কাহিনি শুনে আলগা একটি সমতল স্টোনস্ল্যাবের ওপর জলঢালা মেয়েটির দিকে আরেকবার তাকাই, কিন্তু মশালের উল্টা দিকে দাঁড়িয়ে আছে বলে তার মুখ স্পষ্ট হয় না, তবে গুহার দেয়ালে তার ছায়াশরীরে যেন খেলে যায় তরতাজা যৌবন।

পা-মোয়াং পাহাড় থেকে বেরিয়ে আমি বুড়োকে নিয়ে চলে আসি পাকসান টাউনে। টাউন তো নয় অনেকটা বাজারের মতো। কাঁচা সড়ক ধরে ঢোকার মুখে চোখ পড়ে জনপদের প্রেক্ষাপট হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা নীলচে-সবুজ পাহাড়ের দিকে। পাকসান শহরে মন্দিরসংলগ্ন নোনাধরা একটি বৌদ্ধ-স্তূপা ছাড়া দেখার মতো তেমন কিছু নেই। তো মন্দিরের প্রাঙ্গণে সামান্য ঘোরাফেরা করে আমরা একটি রেস্তোরাঁয় এসে বসি। দু বাটি ফা স্যুপের অর্ডার করে অতঃপর ডাবের পানি পান করি। হঠাৎ করে খেয়াল হয়, জানালা দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন এক মহিলা। এ মহিলার বয়স হয়েছে অনেক। তার পাকা চুলের নিচে কপালে কুঞ্চনের ব্যাপক রেখা। মহিলা রেস্তোরাঁয় ঢুকে আবার আমাকে নিরিখ করে দেখেন।

মহিলার আচরণ খানিকটা উদ্ভ্রান্ত। ধুলিবালি মাখা কোঁচড় থেকে তিনি বের করেন একগুচ্ছ হিকামা বলে অনেকটা মূলার মতো শিকড়। মহিলা একটি শিকড় বেসিনে ধুয়ে পিরিচে করে নিয়ে আসেন আমার জন্য। তিনি আবার আমাকে খুঁটিয়ে দেখেন। ভারি অস্বস্তি হয়, তাই আমি বুড়োর হাতে অল্প কিছু টাকা দিয়ে তা মহিলাকে দিতে বলি। না, মহিলা ভিখারি নন, টাকা নেওয়ার প্রশ্ন ওঠে না। তিনি তার ছেলেকে খুঁজছেন। বিষয় কী? তার ছেলে একসময় নাটকে কস্টিউম পরে চেহারা বদলিয়ে নাকি পার্ট করত। মেকাপ পরলে ছেলেকে তিনি একেবারেই চিনতে পারতেন না। আমার গোঁফের দিকে তাকিয়ে তার সন্দেহ হয়েছে, ছেলে হয়তো কৃত্রিম গোঁফ লাগিয়ে মেকাপ পরে আবার ফিরে এসেছে, আর তিনি তাকে ঠিক চিনতে পারছেন না। মহিলা খুব বিনীতভাবে আমার হাত স্পর্শ করতে চান। তিনি খুঁটিয়ে আমার চামড়ার বর্ণ, ঘড়ি ও আংটি পরীক্ষা করেন। না, আমি তার ছেলে নই বুঝতে পেরে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বেরিয়ে যান তিনি।

আমি একটু বিভ্রান্তবোধ করি। বুড়ো আস্তে আস্তে ঘটনাটি আমাকে বুঝিয়ে বলেন। বছর বিশেক আগে যুদ্ধে মহিলার একমাত্র ছেলে নিখোঁজ হয়। সে কোনো নারী নিয়ে পা-মোয়াং পাহাড়ের গুহায় নিখোঁজ হলো কি না, এ সন্দেহ থেকে তিনি পাহাড়ের সুড়ঙ্গে সুড়ঙ্গে মশাল জ্বালিয়ে অনেক খুঁজেছেন। তারপর থেকে মহিলা বাসস্টপে এসেও মাঝেমধ্যে ছেলের খোঁজ করেন। তার ধারণা, ছেলে হয়তো নাটকের ধড়াচূড়া পরে এ টাউনেই ঘোরাফেরা করছে; আর মুখে মেকাপ, মাথায় পরচুলা থাকার ফলে মা হয়ে তিনি ছেলেকে ঠিক চিনতে পারছেন না।

ফেরার পথে গাড়ি ড্রাইভ করতে করতে আমি মন্দিরের প্রাঙ্গণে মহিলাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখি। কী এক কৌতূহলে গাড়ি সাইড করে তাকে পর্যবেক্ষণ করি। মহিলা কপালে হাত দিয়ে স্তূপার আঙিনায় জড়ো হওয়া পূজারি-পুরুষদের খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছেন। কোনো কার্যকারণ ছাড়া বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে অস্বস্তি হয়, তাই গাড়িটি ফের স্টার্ট দেই, কিন্তু রিয়ারভিউ মিররের দিকে তাকাই না, তবে কোথায় যেন মনের কোনো গভীর গহনে গুহাবহুল একটি পাথুরে পাহাড় ও একজন অচেনা জননীর মুখ ছাপচিত্র হতে থাকে।